রজনীগন্ধার মালা
মা ছবি হয়ে গেছে অনেকদিন। মায়ের ছবিতে রজনীগন্ধার মালা ঝোলাই বচ্ছরকার দিনটিতে। জিয়ন্তে মা কখনও রজনীগন্ধা দ্যাখেনি। আমাদের বাড়ির চারধারের ছোটো বাগানে লঙ্কা, বেগুনের সঙ্গে ছিল টগর-বেলি-গন্ধরাজ-শিউলি-চাঁপা। রজনীগন্ধা ওই তল্লাটে পাওয়াই যেত না। তখন ফুলের দোকানও ছিল না। পুজোপার্বণে নিজেদের আর পড়শিদের বাগানের ফুল দিয়েই কাজ চলে যেত।
মা-ই কিন্তু ছোটোবেলায় আমাদের রজনীগন্ধার নাম বলেছিল। প্রাইমারি স্কুলে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন হতো— পাঁচটা গন্ধযুক্ত ফুলের নাম করো, আর তার উত্তরে মা আমাদের শিখিয়েছিল বেলি-টগর-গন্ধরাজ-চাঁপা-রজনীগন্ধা। শিউলি বা জুঁই ফুলের নাম বললেও হতো, কিন্তু মা যেন চাইত আমরা রজনীগন্ধা নামটা অবশ্যই বলি। নামটা অবশ্য আমারও খুব ভালো লাগত। অন্যান্য ফুলের নামের তুলনায় বেশি মিষ্টি, বেশি অভিজাত। শিউলি, টগর, জুঁই পাশের বাড়ির মেয়ে, রজনীগন্ধা যেন দূরের রাজকন্যা। মা আমাদের বলেছিল যে রজনীগন্ধা আমাদের আশেপাশে কেন, গোটা জেলায় কোথাও হয় না। তখন আমি ভেবেছিলাম, আমাদের এই শেয়ালডাকা জলা-টিলা-জঙ্গলের দেশ, গরুছাগলচরা মাঠ, রাখাল-চাষাচলা মাটির রাস্তা, বাঁশ-মাটি-খড়ের ঘর— এর মধ্যে এত মিষ্টি নামের ফুলটা হতেই পারে না। ওই ফুল যেখানে হয়, সেটা নিশ্চয়ই অন্যরকম। ছবিতে সুন্দর দেশ যেমন দেখায়, তেমনি সুন্দর জায়গায়। মাও রজনীগন্ধা দ্যাখেনি। কিন্তু মার ফুলটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, বুঝতাম। বিজ্ঞান বইতে ছবি ছিল, আমাদেরও দেখিয়েছিল। ছোটো কল্কে ধরনের ফুল। ছবি দেখে আমার তেমন মন ভরেনি, কিন্তু ভেবে নিয়েছিলাম, আসল ফুল ছবির চাইতে অনেক বেশি সুন্দর হবে। কিন্তু রজনীগন্ধার গাছ কেমন হয়, ফুল ঘন্টা বা গন্ধরাজের মতো এককভাবে, না অতসীর মতো মঞ্জরী হয়ে, না করবীর মতো থোকা থোকা ফোটে, তা মা বা আমরা কেউ জানতাম না। মা আমাদের সবসময়েই বলত, তোমরা বড়ো হও, লেখাপড়া শিখে মানুষ হও, কত কিছু নতুন দেখতে পাবে, কত নতুন জায়গায় যেতে পাবে, কত ভালো ভালো জিনিস খেতে পাবে। আমি কল্পনা করতাম, বড়ো হলে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে রজনীগন্ধা কোথায় ফোটে সেখানে যাব, মাকেও সঙ্গে নিয়ে দেখাব। মা বলত, তখন বাগানে রজনীগন্ধার গাছ লাগাবে।
মা-ই আমাদের ছোটো বাগানে ফুলগাছগুলোর যত্ন করত। দরকার মতো জল দিত, গাছের গোড়ায় দিত সার-মাটি, আগাছা হলে তুলে ফেলত। মায়ের যত্নে সতেজ সবুজ গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে উঠত। রোজ ভোরবেলা সেই ফুলবাগান থেকে পুজোর ফুল তোলা ছিল মার প্রথম কাজ। তারপর ঘরের বাসিকাজ সেরে চান করে রান্নাঘরে ঢুকত। চা করে বাবাকে দিয়ে একটুখানি নিজেও খেত। তারপর চান করতে তাড়া লাগাত আমাদের। ভাতে ডালের পুঁটুলি ফেলে দিয়ে আমাদের জন্য ভাত চড়াত মা, হয়ে গেলে পুঁটুলি খুলে সেদ্ধডালে তেল নুন কাঁচালঙ্কা মেখে সেই দিয়ে ভাত খেতে দিত। ডাল না হলে আলু ঝিঙে ঢ্যাড়স ভাতেও চলত। এই দিয়েই খেয়ে আমরা হুড়মুড়িয়ে স্কুলে যেতাম।
মাকে সারাদিন বসতে দেখতাম না। সকাল থেকে কাজ, দুপুরে রান্নাখাবার পর বড়োজোর পনেরো মিনিট আধঘন্টার বিশ্রাম। তারপর কুয়ো থেকে জলতোলা, গাছের যত্ন, বিকেলের গোছগাছ, ছেঁড়াফাটা সেলাই, তারপর সন্ধে দিয়ে আমাদের পড়তে বসানো, তারপর রাতের রান্না।
একসময় কাজ করতে করতে নিজেকে ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে মায়ের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। আমরা তখন নিজেদের জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত। মাকে আর রজনীগন্ধার গাছ দেখানো হল না, মায়ের বাগানে রজনীগন্ধার গাছ লাগানো হল না। মাও আর শেষের দিকে বলত না। তার আরও অনেক ইচ্ছের মতো এটাও অপূর্ণই থেকে গেল। তাই চিকিৎসার জন্য শহরে আনার পর যখন মা মারা গেল, তার সাধের কথা মনে রেখে রজনীগন্ধার মালা দিয়ে খাট সাজিয়ে দিয়েছিলাম। এবং তারপরেও বছর বছর মার মৃত্যুদিনে ছবিতে রজনীগন্ধার মালা ঝোলাই।
কত বছর পরে ট্রেনে যেতে যেতে দেখলাম বড়ো বড়ো রজনীগন্ধার খেত ধানজমির মাঝখানে, রেললাইনের ধারে। খেতের ধারে ধারে লাইন করা গাঁদার গাছ, মাঝে মাঝে জবাগাছও। তবু কেমন যেন ছাড়াছাড়া, সব মিলিয়েও মায়ের সেই ছোটো বেল জুঁই চাঁপা শিউলির বাগানের মতো ভালো লাগল না, কীসের যেন অভাব। দেখলাম, ফুলের খেত ন্যাড়া করে ফুল, কুঁড়ি কেটে কেটে তোলা হচ্ছে। কুঁড়িতেই ফুলগুলো তোলা হচ্ছে, বোঝাই করা হচ্ছে গাড়ি, বাজারে যাবে।
ভাগ্যিস মা ফুলের খেত দেখেনি। দেখলে তার মোটেই ভালো লাগত না। মা তো বাগান দেখতে চেয়েছিল।