কল্পবাস । দেবব্রত পাল
(উপন্যাস)
'পরনে গেরুয়াবসন, বহুকাল পর পিতৃগ্রামে এসে দাঁড়ালেন সূর্যশেখর। কল্পবাস গ্রাম। যার ভূত-ভবিষ্য রঘুবাবু আর বিলাস ঘোষের মতো নেতা-মস্তানদের আঙুলে নাচ করে। যার সরল জল-আলো-বাতাসকে ফালা ফালা করে ভাটিউলি লবঙ্গর খেউড়। এই লবঙ্গ আর বিলাসের শঙ্খ লাগে। অথচ বিলাসের ঘরে শিক্ষিতা সুন্দরী বউ কল্পনা। ছেলের পাপে জ্বলে মরেন নিশি ঘোষ। বৌমাকে ভর্তি করে দেন ইস্কুলে। অঙ্গারের মতো জ্বলতে জ্বলতে কল্পনা পেরিয়ে যায় উত্তরণের এক-এক চৌকাঠ। আর সমস্ত কিছুকে যেন অজান্তেই বুকের ওপর ধারণ করেন ঠাকুরমশাই সূর্যশেখর। কল্পবাস ছাড়তে মন চায় না। অথচ ছাড়তে যে হবেই। কিন্তু কেন? কোন অতীতের তাড়নায় অহরহ জ্বলছেন সূর্যশেখর ওরফে সান? আর কোনো লুকোনো নাম আছে নাকি তার?'
এখন রুকাই নদীর ব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে জটু। তার বসার ভঙ্গিটি বড়ো চমৎকার। রেলিংয়ের দু-পাশ দিয়ে পা দুটো ঝুলিয়ে দুই পা পেঁচিয়ে রেখেছে। আর গোটা শরীরটা যেন হাওয়ায় দোদুল্যমান। তার পরনে অতি জীর্ণ জিন্সের প্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি। মাথার চুলগুলো কীর্তনীয়াদের মতো বড়ো বড়ো, তবে ভারি রুক্ষ। গালে লতিয়ে নামা দাড়ি। চোখে খেলনা সানগ্লাস। তার বাঁ-বগলে ধরা রয়েছে একটা আনন্দলহরী, বাউলরা যা ব্যবহার করে; গ্রামবাংলায় যাকে বলে ‘খমক’ বা ‘ঘোঙা’। সে আপন মনে ডান-হাতের ঝিনুকটা দিয়ে খমক বাজাচ্ছে আর মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। কখনও বা খমক বাজানো ছেড়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে কী যে বলছে কে জানে। খমকের ঘুনঘুনাঘুন ছড়িয়ে পড়ছে রুকাইয়ের নীলচে জলে, নদীপাড়ের সাঁইবাবলা গাছের ডালে, উড়ন্ত পাখির ডানায়। এখন মাঝ-মার্চের সকাল দশটা। ব্রিজের ওপর দিয়ে লোক চলাচলের বিরাম নেই। রুকাই নদীর দক্ষিণপাড়ে কল্পবাস গ্রাম, যাকে লোকে ছোটোকল্পবাস বা ছোটোকল্পা বলে জানে। আর উত্তর দিকে বাজারপাড়া, লোকের মুখে মুখে বড়োকল্পবাস বা বড়োকল্পা। এই বাজারপাড়াই কল্পবাস গ্রামে বেশ জমজমাট জায়গা। বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন, স্কুল, হাসপাতাল সবই ওদিকে, তাই মানুষের চলাচলও বাজারপাড়ার দিকেই বেশি। বাস ধরতে, হাসপাতালে যেতে, স্কুলে পৌঁছাতে মানুষ তো গঞ্জের দিকে ছুটবেই। আর এখন, এই দশটার সময় তো যাকে বলে মার-মার সময়। সকলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। জটুর অবশ্য অত তাড়াহুড়ো নেই। আপন মনে খমক বাজিয়ে চলেছে। দেশ-গাঁয়ে সবসময়েই কিছু কর্মহীন মানুষ থাকে, তারা জটুর মতপ মানুষকেই খোঁজে সময় কাটাবে বলে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তেমনই একজন এগিয়ে এল আরে জটুভাই, তুমি যে দেখি বাউলদের মতো খমক বাজাতে শুরু করলে। তা এটা পেলে কোথায়? জটু খমক বাজাতে বাজাতেই গম্ভীর মুখে বলল, আমার বউ কিনে দিয়েছে। লোকটা মজা পেয়ে বলল, তাই নাকি? বউ তাহলে তোমাকে খুব ভালোবাসে বলো? জটু তার জটওলা চুল নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাকে গতরাতে আচার দিয়ে রুটি দিয়েছিল। যেন আচার দিয়ে রুটিটা ভালোবাসার অকাট্য প্রমাণ! লোকটি এ কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ল। আশপাশে আরও জনাদুয়েক লোক মজা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তাদের একজন বলল, তোমার বউ রাতে কেবল আচার দিয়ে রুটি দিয়েছে? আর কিছু দেয়নি? আরও কিছু? জটু যেন জটিল প্রশ্নের সামনে খেই হারিয়ে ফেলল। বলল, আর কী দেবে? আর কী দেবে মানে? রাতে কত কী দেওয়ার থাকে! তোমার বউ যদি সবই বিলাস ঘোষকে বিলিয়ে দেয় তাহলে তুমি আর কী পাবা বলো? পাশ থেকে অন্য জন বলল, এই থামো, আর নেমো না। লবঙ্গ শুনতে পেলে পিণ্ডি চটকে ছাড়বে! লোকটা কোনো এক লবঙ্গের উদ্দেশ্যে একটা অশ্লীল খিস্তি মেরে বলল, আরে ছাড়ো তোমার লবঙ্গ! ওর পিণ্ডি কে চটকায় তার ঠিক নেই, ও কিনা আমার পিণ্ডি চটকাবে! যাকগে, চলো বাজারের বেলা হয়ে গেল। বলে বাজারের দিকে হাঁটা দিল। জটুকে ইশারায় বলে গেল, তাহলে জটুভাই, যা বললাম, আজ রাতে যেন শুধু রুটি আর আচারেই শেষ কোরো না! জটু কী বুঝল সে-ই জানে, নিদারুণ পুলকে দ্বিগুণ বেগে খমক বাজাতে শুরু করল। এই সময়ে ছোটোকল্পার দিক থেকে একটা মাঝারি মাপের মিছিলকে বাজারের দিকে আসতে দেখা গেল। আজ বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। শীত চলে গেছে বেশ কিছুদিন হল, তবু তার ঠান্ডা আমেজটা এখনও রয়ে গেছে। রোদের ঝাঁজটা ততটা নেই, আবার শরীরে শীতের জড়তাও নেই। এমন দিনে মিছিল-টিছিল বেশ জমে যায়। রঘুবাবুদের মিছিলটায় তাই বেশ দলে ভারি হয়েছে। মিছিলটা কাছাকাছি আসতেই জটুর যেন আর আনন্দ বাঁধ মানল না। রেলিং থেকে লাফিয়ে নেমে সুড়ুৎ করে মিছিলের ভিড়ে মিশে গেল। তারপর জোরে জোরে খমক বাজাতে শুরু করল। মিছিলের যিনি কর্তা, অর্থাৎ রঘুবাবু, জটুকে অমন মিছিলে ভিড়ে যেতে দেখে বিরক্ত হওয়ার বদলে বিব্রতই বেশি হলেন। মিছিল থেকে যেসব স্লোগান উঠছে তা যদি জটুর মর্মে পৌঁছত তাহলে কিছুতেই মিছিলে জুটে যেত না। কথায় আছে, ‘যার নাই উত্তর-পুব, তার মনে সদাই সুখ’, এও হয়েছে তাই! তিনি আর কী করবেন, কেউ মিছিলে পা মেলালে তিনি তো আর গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারেন না, বিশেষ করে জটুর মতো একজনকে। তাতে তাঁরই বদনাম। তিনি তাই হাসিমুখেই মেনে নিলেন জটুর এই পাগলামী। ব্রিজ পেরিয়ে শুরু হয়েছে বাজার। দোকানপাট, চা-গুমটি, সাইকেল সারানোর দোকান, চিকেন স্টল সবকিছু যেন একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বস্তুত কোথায় যে ব্রিজের শেষ আর কোথায় বাজারের শুরু তা বোঝা মুশকিল। বাজারের এই অংশটার নাম নতুনপট্টি। নতুনপট্টির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় লবঙ্গর বাড়ি। বাড়ি বলতে অবশ্য আহামরি কিছু নয়। টালির ছাউনিওলা দাঁত-বের-করা ইটের গাঁথনির দুটি ঘর আর বারান্দা। বাড়ির গেটটা ক্যানেস্তারা টিনের। তার সামনে, মানে রাস্তার পাশটিতে একটা চা-গুমটি, লবঙ্গ এই গুমটিতে বসেই প্রতিদিন চা বিক্রি করে। মিছিলটা ব্রিজ পেরিয়ে লবঙ্গর চা-গুমটির কাছাকাছি আসতেই কী হল, হঠাৎই স্লোগান-শাউটিং যেন চতুর্গুণ বেড়ে গেল। সব স্লোগানই চা-গুমটির বিরুদ্ধে। ভাবখানা এমন, যেন মিছিলওলারা পারলে চা-গুমটিটা এক্ষুনি ভেঙে দেয়। মিছিলের উত্তেজনার আঁচ জটুর মনেও লাগল নিশ্চয়। সেও চতুর্গুণ বেগে মাথা নেড়ে নেড়ে খমক বাজাতে থাকল, সেই সঙ্গে নাচ! একসময় মিছিলটা নতুন পট্টি ছাড়িয়ে পুরোনো বাজারের দিকে বেঁকে গেল। সেখানে চার মাথার মোড়ে নেতাজী মূর্তির পাদদেশে যাবতীয় সভা-সমিতি বক্তৃতাবাজী হয়। জটু মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে চার মাথার মোড় পর্যন্ত গেল বটে কিন্তু পরক্ষণেই তার নজরে পড়ল একই রকমের আর একটা মিছিল উলটোদিক থেকে আসছে ছোটোকল্পার দিকে যাওয়ার জন্য। সে নিমেষে নতুন মিছিলটায় ভিড়ে গিয়ে একইরকম খমক বাজাতে থাকল। তারপর নতুনপট্টিতে এসে হাজির হল। এই মিছিলের লোকেদেরও যত হম্বিতম্বি ওই লবঙ্গর চা-গুমটিকে ঘিরেই। জটু একই রকমভাবে নাচতে থাকল। কেউ তাকে বাধা দিল না, বরং কেউ কেউ হেসে তাকে আরও নাচানাচি করতে উসকে দিতে থাকল। মিছিলের কেউ না দেখতে পেলেও লবঙ্গ কিন্তু এতক্ষণ দুটো মিছিলকেই তীক্ষ্ণ নজরে রেখেছিল। ওদের নাচন-কোঁদন, তার চা-গুমটির বিরুদ্ধে স্লোগান— সবই সে মনে মনে গেঁথে রাখছিল। প্রথম মিছিলেই সে দেখেছিল এলাকার তাবৎ মানুষের কাছে তাকে হাস্যাস্পদ করে জটু তারই বিরুদ্ধে মিছিলে হাঁটছে। শুধু তা-ই নয়, খমক বাজিয়ে সকলকে আনন্দ প্রদান করছে। রাগে তার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল চুলের গুছি ধরে টেনে নিয়ে এসে আচ্ছা করে দু-ঘা বসায়। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখছিল। কারণ এখন হঠকারিতার সময় নয়। তার সময়টা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু তার সংযম আর বাঁধ মানল না দ্বিতীয় মিছিলেও জটুকে নাচতে দেখে। ক্ষোভমত্তা ভৈরবীর মতো এলোচুল উড়িয়ে সে চা-গুমটি থেকে লাফ মেরে নেমে এল রাস্তায় তারপর জটুর চুল ধরে টেনে নিয়ে এল বাড়ির উঠোনে। বারান্দায় রাখা একটা মোটা লাঠি দিয়ে পাগলের মতো প্রহার করতে থাকল। জটুর চেহারা কিন্তু মোটেও রোগা-পাতলা নয়, সে যদি লাঠি কেড়ে নিয়ে প্রত্যাঘাত করে তাহলে লবঙ্গর পেরে ওঠা মুশকিল। কিন্তু সে ওসবের ধারই মাড়াল না। মার খেতে খেতে একসময় লুটিয়ে পড়ল উঠোনে। নতুন পট্টির লোকজন স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল লবঙ্গর কাণ্ড। কেউ কেউ মন্তব্য করছিল, আরে, মেয়েছেলেটা তো দেখছি জটুটাকে খুন করে ফেলবে! তোমরা কেউ যাও, ওকে বাধা দাও! কিন্তু কেউই সাহস করে এগিয়ে যেতে পারছিল না। কারণ নতুনপট্টির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে লবঙ্গর যাকে বলে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। লবঙ্গর যা দুর্বোধ্য প্রকৃতি, বলা যায় না হয় তো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেই থানায় নালিশ ঠুকে এল! লবঙ্গর দোকানের কর্মচারি পটকা অবশ্য এত বিস্মিত হয়নি। সে যখনই দেখেছিল জটুদা মদের ঠেক-বিরোধী মিছিলে হাঁটছে তখনই আন্দাজ করে নিয়েছিল আজ জটুর কপালে নিশ্চিত কষ্ট নাচছে। কারণ বৌদির হাতে জটুর এমন হেনস্থা মাঝে মাঝেই হয়। সে তাই বিভ্রান্ত না হয়ে কলপাড় থেকে জল নিয়ে এসে মাথায় ঢালতে থাকল। তারপর দোকান থেকে একটা কাচের গেলাসে খানিকটা বিলিতি মদ নিয়ে এসে জটুর মুখের সামনে ধরল। জটুও চোখ খুলে গেলাসটা দেখে চোঁ চোঁ করে মাল সাবাড় করে দিল।