আঁতুড়ঘর : জন্মসূত্রের স্মৃতি ও সরণি
বিপ্লব চৌধুরী
“আমি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। যদিও জন্মসূত্রে পূর্ববঙ্গের। আপাতত যাকে বলা হয় ‘বাংলাদেশ’। ১৯৬৪ সালের এক সকালে আমাদের ছাড়তে হয় জন্মের ভিটেমাটি। তখন আমার বয়স এগারো।’’
শুরুর কথায় জানিয়েছেন লেখক রাজা সরকার। বইয়ের নাম ‘আঁতুড়ঘর’। সেই ভিটেমাটি ছেড়ে আসার স্মৃতি ও বেদনার সরণিই এই বইটির পটভূমি অথবা পর্যটন। জন্মসূত্রের সেই আঁতুড়ঘর ছেড়ে আসা লেখকের কাছে একটা আঘাত, আঘাত থেকে সৃষ্ট ঘা, যাকে অস্বীকার করা যায় না। এই বইটির লেখা সেই অনুভূতিকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৭-২০০৮ এই সময়পর্বে একটি বাংলা ব্লগে লেখাটি লেখেন তিনি, পরবর্তীতে বই হিসেবে মুদ্রিত হয়। বেশ কয়েকবার বইটি পড়েছি আমি। প্রতিটি পাঠ-অভিজ্ঞতাই আমাকে দেশ ছেড়ে আসা এক সদ্য কিশোরের বেদনায় বিহ্বল করেছে, আবার রচনার সহজ ও অকপট চলনটি মুগ্ধ করেছে, জড়িয়ে নিয়েছে এক অদ্ভুত আবেশে। কবি ও গদ্যকার রাজা সরকারের লিখনভঙ্গিমার সঙ্গে আমার অনেকদিনের পরিচয়, সেই পরিচয়ের প্রসঙ্গেই বলতে পারি, এই বইটির ক্ষেত্রে সাহিত্য রচনার কোনো অভিপ্রায় লেখকের না-থাকলেও রচনায় রয়েছে সেই আশ্চর্য গুণ, যাকে প্রসাদ বলা হয়। ফলে সংবেদনশীল পাঠকের কাছে প্রিয় হবে এই বই, এমন সম্ভাবনা যথেষ্টই আছে।
বইটিতে আছে ‘আঁতুড়ঘর’ ও ‘ফিরে দেখা আঁতুড়ঘর’ দুটি পর্যায়। প্রথম পর্যায়ের ‘শুরুর কথা’ পেরিয়ে ‘পর্ব-২’ এর শুরুতে আমরা পড়ি... “তখন আমরা ফাইভ সিক্সের পড়ুয়া। সে সময় এক গভীর বর্ষার দিনে আমরা দু-ভাই গেছি আমাদের উত্তরের মাঠের দিকে, আমাদের একমাত্র গাইটির সন্ধানে। কোন সকাল থেকেই সে ঘাসের খোঁজে বেপাত্তা। আমাদের অঞ্চলের বর্ষা মানে ভীষণ জল কাদা।
কিন্তু তার মধ্যেই সেখানে গাই খোঁজার বদলে দু-ভাই অনেকক্ষণ তাকিয়েছিলাম উত্তরের পাহাড়টির দিকে। বোধ হয় ওটাই প্রথম পাহাড় দেখা। মেঘেঢাকা সারা আকাশ যেন সেদিন একটুখানি চাদর সরিয়ে একটি বৃষ্টিভেজা পাহাড়শ্রেণি শুধু আমাদের দেখানোর জন্যই উত্তর দিগন্তে সাজিয়ে দিল। নীল রঙের পাহাড়! গাই খোঁজার বদলে আমরা দু-ভাই জল কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ঐ পাহাড়শ্রেণির দিকে তাকিয়েছিলাম।
বিস্ময়ে হতবাক আমার সম্বিৎ ফিরলো দাদার কথায়—‘ঐডা গার পাহাড়, ভূগুল বইয়ে পড়ছ নাই উত্তরে গার পাহাড়, পার অইলে ঐ পাড়ে হিন্দুস্থান’।”
সেদিনের সদ্য কিশোর, পরবর্তীতে এই বইটির লেখক সেই রাতে ওই নীল পাহাড়শ্রেণির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর কিছুদিনের মধ্যেই ওই পাহাড় ডিঙিয়ে, জন্মসূত্রকে পিছনে ফেলে রেখে তাঁকে চলে আসতে হবে এপাড়ের হিন্দুস্থানে, কথাটা তখনও জানা ছিল না তাঁর। এর পরের পর্বগুলিতে আমরা পড়ব সেই মর্মস্পর্শী বিবরণ।
১৯৬২/৬৩ সাল। লেখকের জীবনের প্রথম শহর নেত্রকোনা। সদ্য সদ্য গ্রাম তথা ভাটি অঞ্চল থেকে পড়তে এসেছেন সেখানকার দত্ত হাইস্কুলে। দাদা পড়ার জন্য আরও দূরে মুক্তাগাছায়। নেত্রকোনায় ছাত্র লেখকের প্রাণপ্রিয় বন্ধু হয়ে উঠল মনতোষ। তার মুখেই প্রথম শুনলেন রায়ট শব্দটি। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে প্রায় কানে কানে বলল, আইজ রাইত রায়ট অইব। বাড়িতে ফিরে দেখলেন থমথমে পরিবেশ। সে রাতে তেমন কিছুই ঘটল না। কিন্তু লেখকের কথায়, প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনাটি যেন আমার বয়স বাড়িয়ে দিল।
এইভাবেই বড়ো হয়ে ওঠে মানুষ। জীবনের রুদ্ধশ্বাস ও কষ্টকর সব অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে। তারপর দেখতে দেখতে ঘুরে গেল বছর, ফাইনাল পরীক্ষাও হয়ে গেল। এরপর ক্লাস সেভেন, মনে তারই আনন্দ। যে বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন, সেই বাড়ির তিন পিসিরই পড়াশোনা ক্লাস এইটের পর বন্ধ হয়ে গেল। বড়োদের মতে, হিন্দু মেয়েদের বেশি পড়াশুনায় কাম নাই। রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। পাশ করেছেন। এল নতুন বই, আর বড়োপিসির বিয়ের দিন। কিন্তু সেই বিবাহ লেখকের বালক ‘আমি’টিকে ঠেলে দিল চেনা কক্ষপথের বাইরে। কারণ, ওই বাড়িতে থেকে আর পড়াশোনা করা যাবে না। এবার থেকে সেখানে থাকবে বড়ো পিসির দেওর।
পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল, অর্থাৎ ‘পড়া ছাড়ান’। দিন কাটে বাড়ির গোরুর পরিচর্যা করে। দেশজুড়ে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার আবহ ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। অবিবাহিতা কন্যা ঘরে আছে মানে রাতে ঘুম নেই। রাজা সরকার লিখছেন... “একটা সর্বাত্মক সহায়হীন অবস্থা। যদিও সব আছে— রাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, মিলিটারি। কিন্তু আসলে কিছুই নেই। সহায়তা চাইলে বিপদ যেন আরো বেশি। আর এই অবস্থায় প্রতিটি রাত যেন একেকটা বিপজ্জনক সেতু। নিরাপদে ভোর হওয়া যেন নতুন জীবন।”
ঢাকায় শুরু হল রায়ট। কোনোমতে বেঁচে ফিরলেন লেখকের সদ্য ম্যাট্রিক পাশ-করা মেজদা। রেলস্টেশনে আসার পথে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন যে বেবী ট্যাক্সির ড্রাইভারের বুদ্ধিতে, তিনি ছিলেন মুসলমান। এই ঘটনার পর গোপনে সিদ্ধান্ত হল লেখকেরা তিন ভাই এবং সঙ্গে তাঁদের ঠাকুমা পালিয়ে বর্ডার পার হবেন। বাড়িতে থেকে যাবেন বাবা-মা ও আরও দু-বোন, এক ভাই। সবাই যেন না মরে, কেউ কেউ বাঁচুক। পরিবারটি এইভাবেই প্রথম ভাঙল।
এরপর জলপথ, রেলপথ, অনেক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, বাধা-বিপত্তি, সোমেশ্বরী নদী, সামনের দিকে এগিয়ে আসা ঘন সবুজ গারো পাহাড়ের আকার দেখে অবাক হওয়া। এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছনো। তিনদিনের দিন ওই বাড়ির মাসী... “আমাকে ডেকে বলল— ‘কাইলই তুমরার যাওন। ঐ পাহাড়টা দেখছনা ঐডা পার হওন লাগবো। কী পারবাত? আমি আস্তে আস্তে বললাম—‘পারব।”
আরও অনেক অন্তবিহীন পথ বেরিয়ে বাঘমারা ক্যাম্প। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে আবার একদিন একটা ট্রাকে উঠে পড়া। পাহাড়ি রাস্তায় পাকদণ্ডী বেয়ে উপরের দিকে ওঠা। তারপর আবার সমতল। ডালু ট্রানজিট ক্যাম্প। সেখানে দুটো রাত। আবার ট্রাক-বাহনে। চিঁড়ে গুড় খেয়ে গুহার ভেতর পাতা খড়ের বিছানায় রাত্রিযাপন। দুধনৈ ক্যাম্প, এই ক্যাম্পের সহবাসীদের বইটি উৎসর্গ করেছেন লেখক।
সেখান থেকে একদিন রওনা হলেন শিলিগুড়ি। মেজদার সঙ্গে। ‘আঁতুড়ঘর’ রচনাটি এখানেই শেষ হল।
পরবর্তী পর্যায় ‘ফিরে দেখা আঁতুড়ঘর’ শুরু হচ্ছে ১৯৬৪ সালে। এক বৃষ্টিভেজা সকালে আসাম মেল থেকে লেখক নামছেন শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে। আবার স্কুলে ভরতি হওয়া। ঠাকুমার মৃত্যু। অভাব, অনটন। আই টি আই ট্রেনিংয়ের জন্য মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে পাড়ি। আবার ক্যাম্প, নাম ‘মানা’। নকশালবাড়ি। তামিল-বাঙালি সংঘর্ষ। শিলিগুড়ি ফিরে এসে কলেজে ভরতি হলেন। ঘটনার অনেক ঘনঘটা। আশির দশকে পৌঁছে গিয়েছে লেখনী। লেখক আবার একদিন গিয়ে পৌঁছলেন তাঁর আঁতুড়ঘরের মাটিতে। সেখানে পৌছনোর পর আত্মীয়স্বজনরা যখন আনন্দের কান্নায় সংক্রামিত, তখন কী অনুভব হয়েছিল লেখকের? পড়ে নেওয়া যাক... “অথচ সত্যি বলতে গেলে এই কান্নার বদলে আমার ইচ্ছে ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে এই উঠোনে একবার হামাগুড়ি দিই। এই উঠোন থেকে যে বারান্দাটায় গিয়ে ওঠা যায় তার এক কোণে আমাদের ভাইবোনদের জন্মের সময় বানানো হতো যে আঁতুড়ঘর, যা এখন উদোম খোলা, সেখানে গিয়ে খালি গায়ে একটু গড়াগড়ি করি। কিন্তু না, তা সম্ভব না। এটা কি খুব বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে না?’’
অন্তিমে নিজেকে বলেন লেখক... “কান্না থামাও ধাতস্থ হও— এটা সেই গ্রাম, সেই দেশ, সেই চরাচর। আজ তুমি শুধু অতিথি। পৃথিবীতে এমন অনেক হয়েছে। দ্বিধা কেন, শতধা বিভক্ত মানবযূথ এমন অনেক আছে। তুমি তো ভাগ্যবান যে আসতে পেরেছো— দেখা পেয়েছো রেখে যাওয়া সহোদরাকে, পরিজনদের। অনেকের কাছে সে সুযোগ নেই বা কোনোদিন আর পাবেও না।”
পাঠ-অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একটি বইয়ের মর্মকে কীভাবে তুলে ধরা যায় আমি জানি না, তবে যদি কৌতূহল জাগাতে পারে এই প্রতিবেদন, তাহলে আপনারা অবশ্যই সংগ্রহ করে বইটি পড়ুন। বাংলাদেশের হৃদয় হতে অপরূপ রূপে বাহির হয়েছে এই লেখা।
আঁতুড়ঘর । রাজা সরকার
Comments