বাহিরে কোথাও দূরে ঘন্টার ধ্বনি শোনা যায়, বহু উল্লাস ও হল্লার শব্দজাল এড়িয়ে সে ধ্বনি মর্মে এসে লাগে; পূজার অর্পণমুহুর্ত থেকে কল্যাণ-আবেশ তরঙ্গে তরঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, আমার কাছেও এসে পৌঁছায়। একান্তে পাতার উপর ঝুঁকে থাকা দেহটিকে তুলে নেয় বিষাদাগ্ৰে।
ঘটমান জীবন থেকে বিচ্যূত এই মুহূর্ত আমার কাব্য-প্রেমহীন, আশাহীন, বিবর্ণ! শুধু শূন্য নীরবতার মধ্যে এসে দাঁড়ায় মন্ত্রের কম্পন, অষ্টকাম সুর! মানসে ফুটে ওঠে এক আশ্চর্য রক্তইন্দিবর-সরোবরের ঠিক মধ্যিখানে, তার উপর এসে পড়েছে অজ্ঞাত নক্ষত্রের আলো। জগৎমোহে উদ্যমী মীনরূপি প্রাণ আলোকবৃত্তে প্রদক্ষিণ করছে সেই কল্পকুসুম- পুনঃ পুনঃ। অনন্তে অনন্তে আবর্তমান প্রাণের কেন্দ্রে অপ্রষ্ফুটিত রক্তকমল, এই কমল প্রাণপ্রকৃতির নিহিত সৃজনশক্তির ভাবরূপ। সৃজন মাত্রেই সংঘাত, অনস্তিত্বের স্থিতাবস্থায় বিঘ্ন ঘটিয়ে মায়াস্তরে স্পন্দিত হয় প্রাণ, বেদনার অগ্ৰজ্ঞানে(anticipation) সংগঠিত হয় চৈতন্য। জগৎতোরণে ভেসে আসে মেঘমল্লার, বসন্তপবন, শৈত্যাবেশ- নানা সমীকরণে জীবন বৃদ্ধি পায়। প্রাণ যত প্রগাঢ় হয়ে ওঠে, প্রকৃতিমূল শূন্যতা প্রকট হয় তত। বিপরীত টানে উন্মিলিত চক্ষু পায় দর্শন- ভৈরবীললাটাকাশে বিন্দুবৎ সামান্য ব্রহ্মাণ্ড, সংসারের সমস্ত আলোকসম্ভার বিনষ্ট করে ঘোর আঁধার গ্রাস করে চলেছে অসংখ্য ব্রহ্মযুগ… নবউন্মেষ ঘটে চলেছে আরও কত।
ব্রহ্মাণ্ডের উত্থান-পতন মানুষের অনুভবে সাধারণত গ্রাহ্য হয় না, কালের বোধ তার সীমিত। মানবাবেগে অর্থ পায় পল-অনুপল। ব্রহ্মাণ্ডের কাছে আমাদের অস্তিত্ব অর্থহীন হলেও, আমাদের কাছে এই দীপ্তসংসারবলয়, ব্রহ্মাণ্ডখণ্ড অর্থপুষ্ট (Men may not have any cosmic significance but cosmos is significant for men.) এবং সেখানে ব্যয়িত প্রত্যেক মুহূর্ত আরও গভীর ও বাঙ্ময় হয়ে উঠুক সেটাই প্রচেষ্টা। সেই উদ্দেশ্যে সভ্যতার নানা আয়োজন।
বাহিরে বন্দনারতিরঘন্টাশোনা যায়, ঘুরে ঘুরে তার রেশ আমার কাছে আসে। সামান্য সান্ত্বনায় অন্তরস্থ আঁধারেতুলে ধরে এক নম্রশিখা, তার স্তিমিত বিভায় আবার কলম-উদ্যোগী হই।
ছবি : সংগৃহীত
Comentários