ছেলেবেলায় একটি গান বিস্মিত করত এবং একইসঙ্গে কেমন অদ্ভুতভাবে একটা ছবি এঁকে দিত চোখের সামনে- তা আজও মনে পড়লে চমক লাগে! লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া- ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে/ চাঁদ ফুল জোছনা’ যে বহু ব্যবহারে পুরোনো হয়ে গেছে, সেই ধারণা প্রথম মনে আলোড়ন তোলে। ‘ওগো প্রিয় মোর খোল বাহু ডোর’- এই পংক্তিতে পৌঁছে সুরের দোলায় দুলতে দুলতে আমি স্পষ্ট অনুভব করতাম একটি মেয়ে দুই বাহু মেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে তার প্রেমিককেও আহ্বান জানাচ্ছে এবং তাদের চোখের সামনে ফুলের পাপড়ি মেলার মতো চিরপুরাতন অথচ বিস্ময়করভাবে একটা গোটা পৃথিবী যেন উন্মোচিত হয়ে চলেছে। মনে হত, পৃথিবীটাও যেন তাদের অপেক্ষায় ছিল। প্রেম কী, তা ওই বয়সেও চাপা উত্তেজনার সাথে বুঝতে পারতাম। এই যে প্রেম, তা যে দুজন ব্যক্তির পারস্পরিক আকর্ষণের অতিরিক্ত কিছু হতে পারে, পুরো পৃথিবীটাই (যদিও ভূগোল বইয়ের মানচিত্রের বাইরে পৃথিবীটার আকার ও প্রকৃতির বাস্তব জ্ঞান তখনও ছিল না) যে সেই ভালোবাসায় বাঁধা পড়তে পারে, কুলিয়েও যেতে পারে, সেই প্রত্যয় বোধহয় ওই গান শুনেই প্রথম হয়। আজ বুঝি, ‘ধরনীর ধুলি হোক চন্দন’- এই লাইনটি কী চমৎকার এবং তার তিলক মাথায় এঁকে নেওয়ার মধ্যে কোথাও দেশভক্তির অতিরিক্ত কিছু আছে। অন্নহীন, আশ্রয়হীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এত সহজ অথচ তীব্র আহ্বান খুব কমই এভাবে জনপ্রিয় বাংলা গানে শোনা যায়। হয়তো কোথাও এসব গানই আশি-নব্বইয়ের বাংলা গানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
উপরোক্ত গানটি বহুল পরিচিত, স্বয়ং সলিল চৌধুরীর সুর। আমাদের নব্বইয়ের ছেলেবেলা কিন্তু অনেকখানি মাতিয়ে রেখেছিলেন সলিলের সুপুত্রী অন্তরা চৌধুরী। সম্ভবত আশির দশকের মাঝামাঝি সলিল চৌধুরীর কথা এবং সুরে তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘বেঙ্গলি নার্সারি সংস্’ রিলিজ করে। বারবার শুনে শুনে সেই অ্যালবামের গানগুলি তখন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে’, ‘কেউ কখনও ঠিকদুপুরে’, ‘ও মাগো মা’, ‘ও সোনা ব্যাঙ’, ‘এক যে ছিল মাছি’- এই গানগুলি। মনে আছে মামাবাড়িতে মেজো মামার সাহায্যে ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে গানগুলো তুলেছিলাম নিজে গেয়ে। এতটাই ভক্ত ছিলাম গানগুলোর। অর্থাৎ কোথাও গিয়ে মনে হয়, সেসময় বিনোদনের দুনিয়া যেন ছিল আমাদের কাছে কিছুটা হলেও দূরের গ্রহ- তাই আশির দশকের নক্ষত্রের আলো নব্বইয়ে এসে পৌঁছেছিল আমাদের ঘরে- ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝর্ণা যেথায় / কুলকুল কুলকুল রোজ বয়ে যায় / ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী গল্প শোনায় / রাজার কুমার পক্ষীরাজ চড়ে যায়। / ভোরবেলা পাখনা মেলে দিয়ে তোরা, / এলি কি বল না সেই দেশ বেড়িয়ে?’- এই পংক্তিগুলি যেন ছিল আমাদের সার্থক রূপকথার দেশভ্রমণ। এর পাশাপাশি ‘রানার’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’। এসব গান বড্ড প্রিয়- যা বাংলার মানুষের কথা বলে।
এবার একটু ইতিহাসের ধুলো গায়ে মেখে নেওয়া যাক। ষাটের দশকে পার্কস্ট্রিটের বিভিন্ন পানশালায় মূলত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মিউজিসিয়ানদের সাথে দেখা যেত গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে। তারপর নকশাল আন্দোলন এল, গৌতমকেও একটা চুক্তিতে আসতে হল। ছাড়তে হল এই শহর। সে অনেক কথা। যখন ফিরলেন, মুঠো ভর্তি নতুন গান। তারপর গড়ে উঠল গানের দল ‘সপ্তর্ষি’, ব্যান্ড বলতে আত্মীয়স্বজন। প্রদীপ ও বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যয় ছিলেন ভাই, রঞ্জন ঘোষালও নিকট আত্মীয়, আর তিন বন্ধু আব্রাহাম মজুমদার, তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাপস দাস। পরে যাঁদের নাম হয় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। সত্তরের দশকে কলকাতা শহরটাই যেন ছিল আস্তাবল, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ লড়াই করেছিল, কিন্তু খুব সহজে জমি পায়নি। একাশি সাল নাগাদ দল ভেঙে গেল। কিন্তু ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ফিরে এল। ১৯৯৫ সালে মুক্তি পেল অ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’, পরের বছর এল ‘ঝরা সময়ের গান’, তার পরের বছর ‘মায়া’, ১৯৯৮-এ ‘খ্যাপার গান’। সিনেমার জন্য গান বাঁধার পাশাপাশি গৌতম এমনকি জাতীয় পুরস্কারজয়ী সিনেমাও পরিচালনা করেছেন সেসময়। ‘সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক’ ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁদের প্রথম রেকর্ড। মানুষ তখন গ্রহণ করেনি, কিন্তু পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। প্রমাণিত হল। বাংলা গানে স্যাক্সোফোনের ব্যবহার নিতে সময় তো লাগবেই।
‘এমন বিশাল বন্দরে বহুকাল
থামেনি আকাশবিহারী বিমান যান
এখানে ওখানে আগাছার জঞ্জাল
শূন্য ডাঙায় বায়ু বীতগতিবেগ
এমন ছবিতে কিশোরী মানায় ভালো
ফ্রকে মুখগুঁজে কাঁদে চুল এলোমেলো।’
(‘সংবিগ্ন পাখিকূল’ : গীতিকার : রঞ্জন ঘোষাল)
এই সব পংক্তি তো আসলে অমোঘ কবিতা, গানের গয়নায় মোড়া সাহিত্য। ‘প্রয়াত ধূর্জটি চট্টোপাধ্যায়কে... যে আমাদের গান শুনতে চেয়েছিল।’- লেখা ছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র প্রথম অ্যালবাম ‘সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক গান’ (১৯৭৭) এর উৎসর্গপত্রে (ম্যানিফেস্টোও ছিল)। সঙ্গীতশিল্পী ধূর্জটি চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গীকৃত এই অ্যালবামের ‘সংবিগ্ন পাখিকূল’ এবং ‘হায়, ভালোবাসি’ গানদুটি পরবর্তীকালে যথাক্রমে তাঁদের ‘ঝরা সময়ের গান’ (১৯৯৬) এবং ‘মায়া’ (১৯৯৭) অ্যালবামে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। যাতে কন্ঠ দিয়েছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়, রাজা ব্যানার্জী, বনি এবং ঋতুপর্ণা দাশ। তাঁদের প্রস্তুতি পর্বে ও প্রথম প্রকাশকালে ব্যান্ডের সদস্যদের ভূমিকা ছিল নিম্নরূপ :-
গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মাণিক) - কন্ঠ, কথা, লিড গিটার, স্যাক্সোফোন।
প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় (বুলা) - কন্ঠ, বেস গিটার।
তাপস দাস (বাপি) - কন্ঠ, কথা, গিটার।
রঞ্জন ঘোষাল - কথা, মিডিয়া সম্পর্ক।
আব্রাহাম মজুমদার - পিয়ানো, ভায়োলিন, ভায়োলা।
বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় (বিশু) - ড্রামস, বেস ভায়োলিন, গিটার।
রাজা বন্দ্যোপাধ্যায় - গিটার (১৯৭৮-৮১ সময় পর্বে)
তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (ভানু) - কন্ঠ, গিটার।
তাঁদের পরের অ্যালবামটি ছিল – ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব’ (১৯৭৮), তার একটি গানের সঙ্গে অঞ্জন দত্তের নব্বইয়ের গানে ‘হরিপদ’ কেরানির সরাসরি মিল খুঁজে পান অনেকেই।
‘আধো-আলো-আঁধারের কোনও এক নগরের
মেস ঘরে থাকি চারজন
ট্রাম লরি টেম্পোরা শব্দের আলপনা
দিয়ে ঘিরে রাখে সারাখ’ন।’ (অজানা উড়ন্ত বস্তু...)
এর পরের বছর প্রকাশিত হয় তাঁদের তৃতীয় অ্যালবাম— ‘দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি’। ৭ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ওই অ্যালবামে মোট দুইটি গান ছিল। তারপর তো দীর্ঘ বিরতি। বাউলসংগীত এবং বাংলা রক ধারায় লোক-ঐতিহ্যের স্বাধীনচর্চার পাশাপাশি প্রায়ই উদ্ভাবনী উপায়ে শাস্ত্রীয় উপাদান একত্রিত করার কারণে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’কে এক স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের জন্মদাতা বলা যায়। যে ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। নব্বইয়ের দশকে তাঁরা বিদেশের ‘দ্য ভেলভেট আন্ডারগ্রাউন্ড’ ব্যান্ডের মতো (১৯৬8-তে জন্ম) পুনরায় সমালোচনামূলক মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি পেয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ছে। অথচ এই দূরত্বের কথা গৌতম লিখেছিলেন কয়েক দশক আগে— ‘তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে, তারও দূরে, তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে’।
আশির দশকের শুরুতে ইন্দ্রজিৎ সেন, ইন্দ্রনীল সেন, রিমলি সেনগুপ্ত, ইন্দ্রাণী সেন, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়দের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ‘নগর ফিলোমেল’ ব্যান্ড । ‘ফিলোমেল’ (Philomel) হল নাইটিংগেল, গানের পাখি। তাঁদের প্রথম অ্যালবাম— ‘আমরা গান গাই যে সুরে’ (১৯৮৫), দ্বিতীয় অ্যালবাম— ‘স্বপ্ন নেই’ (১৯৯৬)। এঁদের একটি জনপ্রিয় গান— ‘বিজনের চায়ের কেবিন’। পরে এই দলের ইন্দ্রনীল সেন যেমন রিমেকে এলেন, প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনি চলে এলেন সিনেমার আবহসংগীতে (সম্প্রতি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কারজয়ী)। নব্বইয়ের দশকে বারোটি গানে সমৃদ্ধ সুমনের ‘তোমাকে চাই’ অন্যধারার বাংলা গানকে মূলধারার সরণিতে এনে ফেলেছিল। কিন্তু অরুণেন্দু দাস থেকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ হয়ে, রঞ্জনপ্রসাদ বা ‘নগর ফিলোমেল’-এর সুদীর্ঘ ত্রিশবছরের প্রস্তুতিপর্ব ছিল এর পশ্চাতে। প্রচলিত স্কটিশ প্রার্থনাসংগীত ‘Morning Has Broken’-এর অনুপ্রেরণায় অরুণেন্দু দাস ১৯৭২ সালে ‘হল যে প্রভাত’ গানটি বেঁধেছিলেন, রেকর্ডিং হলেও যা অপ্রকাশিত। অরুণেন্দু দাস ১৯৩৮ সালে ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করেন— সেসময় রেঙ্গুন নামে পরিচিত ছিল। অলটারনেটিভ বাংলা গান রচনার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি, যিনি গিটার সহযোগে গাওয়ার জন্য বাংলা গান রচনা করেন প্রথম। বিভিন্ন পাশ্চাত্য ক্লাসিকের অসংখ্য প্যারোডি রচনা করে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। স্প্যানিশ গিটার নিয়ে চর্চার শুরু তাঁরই হাত ধরে। ‘আয় রে ঘুম আয়’, ‘আছে মোর কিছু সুর’, ‘বড়ি দিয়ে তরকারি’, ‘ভিক্ষেতেই যাবো’, ‘বন পাহাড়ির’, ‘বলতে যা চাও’ ইত্যাদি তাঁর কিছু একক গান। ‘পথের প্রান্তরে’ (১৯৭৮) বা, ‘মহানগর ছাড়িয়ে (২০০২) — রঞ্জনপ্রসাদের এই দুটি অ্যালবামের কথাও হয়তো বাঙালি ভুলেই গিয়েছে। ‘পথের প্রান্তে ওই’ গানটি আজও শুনলে মনে হয় ভীষণ আধুনিক। সেই সত্তরে হেমন্তের সঙ্গে যিনি ‘আয় খুকু আয়’ গেয়েছিলেন, সেই শ্রাবন্তী মজুমদার মানেই এক ধরনের উত্তেজনা— একটা নেশাধরা হাস্কি টোনের সম্মোহন। ‘আহা কপালে আগুন জ্বলে না’ শুনলে আজও তা মালুম হয়। এই সময়ে সরাসরি বাংলা গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও, বিভিন্নভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে প্রভাবিত করেছিলেন ব্যাঙ্গালোরের কার্লটন কিটো (Carlton Kitto, Jazz Guitarist), গায়িকা উষা উত্থুপ, অমিত দত্ত, Bertie Da Silva, Louis Banks (তাঁকে বলা হয়— ‘Godfather of Indian jazz’), নন্দন বাগচী প্রমুখ।
এই যে ব্যান্ডের গান, আমার ক্ষেত্রে অন্তত এদের শোনার শুরু রেডিও এফ.এম চ্যানেলে। সেটা কিন্তু অনেক পরে, ২০০৩ নাগাদ। সুতরাং তার আগের সময়টা বোঝা প্রয়োজন। আমার ৮৮-তে জন্ম, আজ দেখছি আমি নব্বইয়ের অর্ধেক মনে রাখতে পেরেছি, বাকিটা প্রায় ভুলে গেছি। একেবারে ছেলেবেলায় অর্থাৎ নব্বইয়ের শুরুতে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমার গান, ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার, ভূপেন হাজারিকা, জগন্ময় মিত্র, লালকমল-নীলকমল আর বুদ্ধুভুতুম-এর ক্যাসেট বাজত বাড়িতে বাড়িতে, এটা মনে আছে। এরপর প্রায় হঠাৎ করেই শুরু হল রিমেক গানের যুগ। আশির দশক অবধি বাংলা আধুনিক গানের বাজার ছিল— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, লতা-আশা, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ গায়ক-গায়িকার এবং গীতিকার ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত প্রমুখরা। এরপর রেকর্ডের যুগ শেষ হল। এল অডিও ক্যাসেট। সাউন্ড কোয়ালিটি হল আগের থেকে ঝকঝকে, ফলে পুরোনো গান রিমেক হলে যে বাঙালি শুনবে, সে বিষয়ে সঙ্গীত দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের সন্দেহ ছিল না। দেখা গেল গীতা দত্তের গান শ্রীরাধা ব্যানার্জির কন্ঠে চমৎকার শোনাচ্ছে। অ্যাটলান্টিস কোম্পানি এসময় নিয়ে এল ‘দূরের বলাকা’ অ্যালবাম সিরিজ। চার ভলিউমে স্বর্ণযুগের বাংলা গান। ১৯৯৮ সালে ইন্দ্রনীল সেনের কন্ঠে ‘দূরের বলাকা’ মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে বিশাল হিট। ‘এই সুন্দর স্বর্ণালি সন্ধ্যায়’, ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে’, ‘ওই যে আকাশের গায়ে’ এই গানগুলি আবার ফিরে এল মুখে মুখে। মনে হত নতুন করে শুনছি। ‘আকাশ ডাকে আজ আমায়’-এর মতো গানগুলোও সেই সময়ে ইন্দ্রনীলের ভরাট কন্ঠে দারুণ জনপ্রিয় হয়। ১৯৯৬ সালে চাকুরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গানের জগতে চলে আসেন শ্রীকান্ত আচার্য। ওই বছরেই ‘সাগরিকা’ থেকে মুক্তি পায় শ্রীকান্তর রিমেক অ্যালবাম— ‘মনের জানালা’। ‘আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি’, ‘রূপের ঐ প্রদীপ জ্বেলে’, ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’, ‘মনের জানালা ধরে’, ‘জেনো কিছু মনে কোরো না’— এইসব গান আবার নতুন করে মাতিয়ে তুলল বাঙালির দৈনন্দিন জীবন। ‘এক ঝাঁক পাখি’ (১৯৯৮), ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ (২০০০) মুক্তির আগে শ্রীকান্ত কিন্তু এই রিমেক গানেই দীর্ঘ সময় মঞ্চ মাতিয়েছেন। পরবর্তীতে জয় সরকারের সুরে শ্রীকান্তর ‘ঘুড়ি’ (২০০8) অ্যালবামে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘পৃথিবীর চাবি’ গানটি। একেবারে অন্যরকম লেগেছিল শ্রোতার কানে। লোপামুদ্রা মিত্রের অ্যালবামগুলিও আসছে ওই ২০০০ সালের পর-পরই। লোপামুদ্রার ‘ভালোবাসতে বলো’ (২০০১) ছিল পুজোর অ্যালবাম। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শুভ দাশগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জয় গোস্বামীর কথায় সুর দিয়েছিলেন কল্যাণ সেন বরাট, সমীর চট্টোপাধ্যায়রা। তবে এই যে নতুন ভাবনা, নতুন সুর— তা গানের জগতে আসতে সময় লেগেছিল। যেমন স্বয়ং শ্রীকান্ত আচার্য স্মৃতিচারণ করেছেন ‘মনের জানালা’ ও তাঁর কেরিয়ার নিয়ে— ‘আমি তো ধরেই নিয়েছি আমার গান কেউ শুনবে না । তাই কাউকে কিচ্ছু বলিওনি। কিন্তু অ্যালবামটা (‘মনের জানালা’) সুপারহিট হল। পুজোর পরই কোম্পানি আমাকে বলল, দাদা, পরের অ্যালবামের চিন্তাভাবনা শুরু করে দিন । আমি ভাবলাম, ও এক বার তালেগোলে হিট করে গেছে, ঝড়ে বক মরার মতো, দ্বিতীয়টা আর হবে না । পরের বছর ‘নীল ধ্রুবতারা’ বেরোল, আগেরটার থেকেও হিট। ’৯৮ আর ’৯৯-এ আরও দুটো অ্যালবাম। কিন্তু তারপর আমি ভাবলাম, রিমেক একটা চলতি ট্রেন্ড, শ্রোতারা শুনছেন কারণ গানগুলো তাঁদের খুব প্রিয়। তাঁরা একটা ফ্রেশ ভয়েসে সেগুলো শুনে আনন্দ পাচ্ছেন। এই হিটের পিছনে আমার কৃতিত্বের কিছু নেই। একেবারে নতুন, মৌলিক গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারাটা ঢের বেশি চ্যালেঞ্জিং, কৃতিত্বেরও। তাই মন দিলাম একেবারে আমার নিজস্ব গান গাওয়ার দিকে। সেই ভাবনা থেকেই ২০০০ সালের অ্যালবাম ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ ( ‘হ্যালো 90’s’ : রবিবাসরীয় প্রবন্ধ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১8 )। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, সময় লেগেছিল মৌলিক গানে ফিরতে। অথচ সেই সময়েই সুমন-অঞ্জন-নচিকেতারা হয়ে উঠেছেন নাগরিক কবিয়াল।’
উপরোক্ত লেখাটিতে শ্রীকান্ত সমালোচনাও করেছেন সেই সময়ের নস্ট্যালজিয়া-চর্বণের অভ্যাসকে— ‘রিমেক-এর গাজর সামনে ঝুলিয়ে কোম্পানিগুলো অসম্ভব প্রতিভাধর সব গীতিকার-সুরকারদের নিরুৎসাহ করেছে। বাংলা গানের কথায়-সুরে কী পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে, বা আদৌ হচ্ছে কি না, তা তো নতুন গানেই বোঝা যাবে। অথচ রিমেক সেই পথটাকে রুদ্ধ করে দিয়ে ঘড়ির কাঁটাকে পুরো উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিল।’ খুব সত্যি কথা— এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরেকজনের কথা মনে পড়ছে। দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গে নব্বইয়ের মাঝামাঝি তিনি দুশোর বেশি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল বানান, তিনি— প্রতীক চৌধুরী। ‘দূরে বহু দূরে, গাইছে বাউল একতারায়’— প্রতীক চৌধুরীর বিখ্যাত এই গানে একসময় গলা মিলিয়েছিল আমবাঙালি। ‘এক যে আছে কন্যা’ (২০০১) ছায়াছবির টাইটেল ট্র্যাকটিও মনে রাখার মতো। মুখোশ, ভূশুন্ডির মাঠে, অভিনেত্রী— তাঁর উল্লেখযোগ্য অ্যালবাম। ‘শুধু তোমারই জন্য’-টেলিভিশন শো-এর টাইটেল ট্র্যাক গেয়ে আমাদের কৈশোরে আলোড়ন তুলেছিলেন, পরমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কন্ঠে আরেকটি গানও প্রায় সবাই শুনেছেন—
‘আমি চাই... ফিরে যেতে সেই গাঁয়
বাঁধানো বটের ছায়,
সেই নদীটির হাওয়া ঝিরঝির
মনের গভীরে পড়ে থাকা যত
স্মৃতি বিস্মৃতি কখনো কি ভোলা যায়?’ (‘ঘরে ফেরার গান’)
চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ক্ষ্যাপার গান’ অ্যালবামে ১৯৯৯ সালে এই গানের রেকর্ডিং করেন। ২০০৩-এ পরমা বন্দ্যোপাধ্যায় এই গানটি আবার গান ।
আসলে ইতিহাস সত্যিই একটা সমুদ্র। ঢেউয়ের সাথে ফিরে আসে গান। তাই তো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ও নচিকেতা-পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানটিকে কালজয়ী করে দেন মান্না দে ১৯৮৩ সালে, নস্ট্যালজিয়ার হু হু স্রোতে। শোনা যায়, গানের শেষ তিনটি লাইন সেসময় ক্যানসার-আক্রান্ত গৌরীপ্রসন্ন লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে, একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে সাদা অংশে। ২০০৬ সালে বিবিসি-র বিচারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় এই গানটি চতুর্থ স্থান দখল করে নেয়। ইতিহাসের স্বভাবই এই, এক সময়ের গর্ভে অজান্তেই ঢুকে বসে থাকে অন্য সময়—
‘সেই সাতজন নেই আজ, টেবিলটা তবু আছে
সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই!
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সেদিনের মালি নেই।’
অতীতচারী কথায় এভাবেই একটা হারানো সময়ের ‘সোনালী বিকেলগুলো’ ফিরে আসে অন্য সময়ে, আচমকাই। এই গান রচনার ইতিহাসটিও তারই সাক্ষ্য দেয়। তাই কবীর সুমন লেখেন—
‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে
চৌরাশিয়ার বাঁশি মুখরিত প্রাণে
ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তর সুরে
কোন্ কবেকার অনুরোধের আসরে...’ (‘তোমাকে চাই’)
কোথাও যেন মনে পড়ে যায় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সেই কবেই এ জিনিস করেছিল বাংলা গানে—
‘ভালোবাসি পিকাসো, বুনুয়েল, দান্তে
বিট্ল্স্, ডিলান আর বেঠোফেন শুনতে।
রবিশঙ্কর আর আলি আকবর শুনে
ভালোবাসি ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফিরতে।’ (‘ভালো লাগে’)
তাই বলাই যায়, কিছুই হারায় না। এমনকি বাংলা গানের কথায় অদ্ভুতভাবে ফিরে আসেন জীবনানন্দ (ব্যান্ডের নামেও) থেকে বিনয় মজুমদার। ‘অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্র নয় / লিখিত বিশ্লিষ্ট রূপ গণিতের অআকখময়।’ (‘অনেক কিছুই তবু’ : বিনয় মজুমদার)
এক ইন্টারভিউতে কবীর সুমন একবার একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন— ‘আমার কোনো ফ্যান নেই। ফ্যান অন্য লোকদের থাকে। আমার খালি শ্রোতা আছেন। তাঁরা বুদ্ধিমান মানুষ।’ (বাংলা নিউজ ২8) ‘সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে’— এমন একজন সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন (!) লোককে নিয়ে গান লিখেছিলেন সুমন, ‘পাগল’ (অ্যালবাম : ‘তোমাকে চাই’, ১৯৯২)। সুমন লিখেছিলেন—
‘আদমসুমারী হলে
তার মাথা কেউ গুনবে না
তার ভোট চাইবে না
গণতান্ত্রিক কোন প্রার্থী,
সরকারে দরকার নেই
তাই নিজের সুড়ঙ্গে
পাগল... পাগল!
একে কী বলা যায়? বাংলা গানের ‘চিরকালীন’ তকমা ঝেড়ে ফেলে সাময়িক বা, সমসাময়িক হয়ে ওঠা? নাকি বলা উচিত দেশ-কাল-সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠা? যাই বলুন, সুমন সেখানে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেনও। ১৯৯৩ সালে, ‘বসে আঁকো’ অ্যালবামের গানগুলো থেকে শুরু করে ‘বাদলবন’ গানের পংক্তিগুলি দেখুন—
‘মানুষ তুমি দূরেই থেকো
তোমার ছোঁয়া ধ্বংস আনে
বাদলবন থাকবে ভালো
বৃষ্টি জানে বনও জানে।’
এসব গানের কথা কি পুরোনো হয়ে গেছে? অপ্রাসঙ্গিক? মনে তো হয় না। তখন নতুন জামা মনে হয়েছিল, এখন বড়োজোর আলনার তাকে ফেলে রেখে কিছুটা মলিন পোশাক বলে মনে হয়।
‘আজকে যে প্রতিবাদী কন্ঠ
সর্বংসহা হবে কাল সে
সয়ে যাবে অসহ্য চশমা
চল্লিশ পেরোলেই চালশে।’
‘চালশের গান’ যেন সুমনের ভবিষ্যদ্বাণী, আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। ‘গানওলা’ অ্যালবামের ‘তোমাকে ভাবাবোই’ গানে, সুমন যেন আমাদের সাথে কথা বলে ওঠেন আজও।
‘তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো
সে তুমি মুখে যাই বলো না
তোমাকে আমি পথে নামাবো
যতই ঘরে বসে থাকো না।’
পান্ডিত্য, মেধা অনেক সময়েই চালাকি এনে দেয় স্বভাবে। হাবে-ভাবে শিক্ষার দম্ভ নিছক বিজ্ঞাপন হয়ে ঝুলতে থাকে তখন। সুমনের গান যেন জ্ঞানের কানমোলা হয়ে ওঠে, সুর ভালো লাগে না, অথবা একঘেয়ে লাগে; কিন্তু কথা হুল ফুটিয়ে যায়। তেতাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম অ্যালবাম বেরোয়। চল্লিশে আমেরিকায় একটি বেতারকেন্দ্রের ‘স্টেডি জব’ ছেড়ে সুমন কলকাতায় চলে আসেন বাংলা গান বাঁধবেন বলে। বড়োই বিতর্কিত জীবন তাঁর, অভিজ্ঞতাও বিপুল। দুনিয়াজোড়া রাজনীতির সঙ্গে অনেকখানি চাক্ষুষ যোগাযোগ আর বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ ও সমাজ কর্মীদের সঙ্গে নানাসূত্রে কথোপকথন যেমন তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তাঁর গানের সুরে-কথায় লেগেছে বিশ্বপ্রাণের সাত রং। ২০০০ সালে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে তিনি তাঁর পদবি পরিত্যাগ করেন। পাঁচটি বিবাহ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থান, বহু বিতর্কিত মন্তব্যের সাথে সাথে এই বাহাত্তর বছর বয়সে সুমন আজও গান নিয়ে রয়েছেন।
নয়ের দশক নানা দিক থেকেই একটা ক্রান্তিকাল। মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং ভোগবাদী বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন, রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির বিষয়হীন বিষণ্নতা এবং গতানুগতিক সংস্কৃতি চর্চার অনুবর্তনে বাঙালি হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত। অনুশ্রী ও বিপুল চক্রবর্তী এসময় ‘সুবর্ণরেখা’, ‘ফুলেরা ডেকেছে’, ‘মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে’, ‘নদীর সামনে’ ইত্যাদি গানে হাজির করেন নতুন কথা ও সুর জাগরণের গান ও তার বাণীরূপ নিয়ে হাজির হন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। খালি গলায় তাঁর গান মূলত নগর কলকাতার বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত তরুণদের আকৃষ্ট করে। ‘আমি বাংলায় গান গাই’— প্রতুল বাবুর এই গান তো সকলেরই চেনা। সুমন এলেন ভিন্ন সুর, ভিন্ন কাহিনি, ভিন্ন গায়ন ও যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে। ‘তোমাকে চাই’, ‘বসে আঁকো’, ‘ইচ্ছে হলো’, ‘গানওলা’, ‘ঘুমাও বাউণ্ডুলে’, ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’, ‘জাতিস্মর’ প্রভৃতি একের পর এক অ্যালবামে নির্মিত হয় সুমন-এর নিজস্ব ভুবন। তবে সেটি পৃথক আলোচনার দাবি রাখে।
‘শরত আসে যায়, মেঘের ফাঁকে নীল / এই শহরটায় অতিথি গাঙচিল।’ (‘অনেক দিন পর’ অ্যালবাম) — যে দুই বন্ধুর অনেক দিন পর আবার এই অ্যালবামে সুর-সংযোগ হল, মিলল গলা, তাঁরা দুজনেই নব্বই মাতিয়েছেন— সুমন ও অঞ্জন দত্ত। সুমনের কথা তো হল, এবার আসা যাক অঞ্জনের কথায়। মৃণাল সেনের ‘চালচিত্র’ (৮১, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা নবাগত অভিনেতার পুরস্কার অর্জন), ‘খারিজ’ (৮২) ছায়াছবির নায়ক অঞ্জন দত্ত এরপরে গানের হাত ধরে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন । ‘শুনতে কি চাও?’ (১৯৯৪), ‘পুরোনো গিটার’ (১৯৯৫), ‘ভালবাসি তোমায়’ (১৯৯৬), ‘কেউ গান গায়’ (১৯৯৭), ‘চলো বদলাই’ (১৯৯৮)— নব্বইয়ের দশকে একের পর এক গানের অ্যালবামে নিজস্ব শ্রোতা তৈরি করে নিয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত। তবে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান বোধহয় ‘বেলা বোস’ ওরফে ‘এটা কি ২৪৪-১১৩৯’! ‘সাদা-কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে’ তাঁর মতোই তাঁর শ্রোতারাও স্বপ্ন দেখেছিল ‘লাল-নীল সংসার’ গড়ে তোলার। এছাড়া ‘দার্জিলিং’, ‘তুমি না থাকলে’, ‘হরিপদ’, ‘রঞ্জনা’, ‘ম্যারী অ্যান’ দারুণ জনপ্রিয় হয়। স্কুল জীবনে শেষোক্ত গানটির লাইনগুলো মাথায় ঘুরত সারাক্ষণ—
‘কালো সাহেবের মেয়ে, ইশকুল পালিয়ে
ধরতে তোমার দুটো হাত
কত মার খেয়েছি, মুখ বুজে সয়েছি
অন্যায় কত অপবাদ
বয়স তখন ছিলো, পনেরো তাই ছিলো
স্বপ্ন দেখার ব্যারাম
মাথার ভেতর ছিল, এলভিস প্রিসলি
খাতার ভেতর তোমার নাম!’ (‘ম্যারী অ্যান’)।— কবীর সুমন আর অঞ্জন দত্ত— দু’জনে এক মঞ্চে, মানেই ন’য়ের দশকের বুকে প্লাবন তোলা স্মৃতি। এখন যাঁদের বয়স চল্লিশের কোঠায়, তাঁদের বড়ো হয়ে ওঠার স্মৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন সুমন আর অঞ্জন দত্ত। পার্ক স্ট্রিটের হার্ড রক ক্যাফেতে আয়োজিত অঞ্জনের ছবি ‘আমি আসবো ফিরে’ (২০১৮)— এর অডিও ডিভিডি লঞ্চ অনুষ্ঠানের মঞ্চে অঞ্জন বলেছিলেন, ‘সুমনের বাংলা গান শুনে আমারও মনে হয়েছিল গান গাইতে হবে। এই শহরটাকে নিয়ে, এই শহরের মানুষগুলোকে নিয়ে, যন্ত্রণাগুলোকে নিয়ে আমারও কিছু বলার আছে, আমারও কিছু গান আছে। তখন থেকেই আমার গান লেখার শুরু।’ দার্জিলিংয়ের মেঘ-কুয়াশার মধ্যে, বড়দিনের বো ব্যারাকে অথবা, কলকাতার হাতিবাগানের ধ্বসে পড়া থিয়েটারপাড়ায় প্রখর রৌদ্রে, কালো চশমা চোখে অঞ্জন দত্ত-কে আরেকটু কাছে থেকে চিনে নিয়ে পড়তে পারেন, সাজ্জাদ হুসাইনের গ্রন্থগুলি— ‘অঞ্জনযাত্রা’, ‘নাট্যঞ্জন’।
১৯৯৩ সালে ‘এই বেশ ভালো আছি’-র হাত ধরে নচিকেতা চক্রবর্তীর আবির্ভাব। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের আশা-নিরাশা, ক্ষোভ-প্রতিবাদ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ ছিল নচিকেতার গানের বিষয়। রাগসঙ্গীতের সঙ্গে সমকালীন সুর-নিরীক্ষা তাঁর গানে চমৎকার মিলে যায়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলে যোগাযোগ স্থাপন করা, কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তদের জনপ্রিয়তার একটি বিরাট কারণ। মূলত নচিকেতার প্রথম অ্যালবামের বিজ্ঞাপন সূত্রেই গ্রামাফোন কোম্পানি ‘জীবনমুখী গান’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করে।
‘নীলাঞ্জনা’, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে’, ‘ডাক্তার’, ‘তুমি আসবে বলেই’, ‘আজ বছর দশ পর’, ‘বৃদ্ধাশ্রম’ প্রভৃতি তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় গান। বিশেষত ‘আজ বছর দশ পর’ কলেজ জীবনে কন্ঠস্থ ছিল— ‘প্রতিটা সকাল যেন দিনের অন্তরা / সন্ধ্যে নামতো ঠিক সঞ্চারী হয়ে, / এখনও তো একইভাবে দিন যায় রাত আসে / বেলাশেষের গান গেয়ে!’— ‘বুকের মাঝে দশ বছরের অবক্ষয়’ বোধহয় এত সরাসরি বাংলা গানে আগে আসেনি । তাঁর অ্যালবামগুলি হল—
‘এই বেশ ভালো আছি’ (১৯৯৩), ‘কে যায়?’ (১৯৯৪), ‘কি হবে?’ (১৯৯৫), ‘চল যাবো তোকে নিয়ে’ (১৯৯৬), ‘কুয়াশা যখন’ (১৯৯৭, এই নামে একটি সিরিয়াল হয়, তাতে গানটি ছিল টাইটেল ট্র্যাকে), ‘আমি পারি’ (১৯৯৮), ‘দলছুট’ (১৯৯৯) ইত্যাদি। কম কাজ করলেও, নচিকেতা এখনও সক্রিয়। নচিকেতা, অঞ্জন, শিলাজিৎ, মৌসুমী ভৌমিক— তাঁরাও কিন্তু নিজস্ব শ্রোতা তৈরি করেছেন এবং ধরে রেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। শিলাজিৎ মজুমদারের অ্যালবাম ‘ভূমিকা’ (১৯৯8), ‘আমরাও বেঁচে আছি’ (১৯৯৫), ‘ঠিক এখানে’ (১৯৯৬), ‘এক্স = প্রেম’ (২০০০) সাউন্ডের উপর দুর্দান্ত কাজ উপহার দিয়েছে শ্রোতাদের। ‘বাজল ছুটির ঘন্টা’ বা, ‘লাল মাটির সরানে’ কখনও ক্ষণস্থায়ী অনুভূতির গান নয়, ওই গান ফিরে ফিরে শোনার জন্য তৈরি হয়েছে। ‘ও জীবন রে জীবন’ বা, ‘ঝিন্টি’ অথবা ‘যা পাখি’— এইসব গান তো আমরা অন্তত কোনোদিন ভুলে যাবো না।
দুই দশকের চলচ্চিত্রের গানে উল্লেখযোগ্য— ‘দাদার কীর্তি’ (১৯৮০), সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০), উত্তমের অন্তিম ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ (১৯৮১), ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘অনুসন্ধান’ (১৯৮১), ‘প্রতিশোধ’ (১৯৮১, বিশেষত ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’ গানটি), ‘ত্রয়ী’ (১৯৮২), ‘মোহনার দিকে’ (১৯৮৩, বিশেষত আশা ভোঁসলের কন্ঠে, ‘বন্ধ মনের দুয়ার দিয়েছি খুলে / এসেছে ফাগুন হাওয়া…’), ‘অন্যায় অবিচার’ (১৯৮৫), ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ (১৯৮৫), ‘প্রতিদান’ (১৯৮৩) ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের ‘মঙ্গল দ্বীপ জ্বেলে’, কিশোরের ‘হা রে রে রে রে রে’, ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ (১৯৮৬), ১৯৮৭ সালে কিশোর কুমার-এর কন্ঠে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার…’
ওই বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবির গান, ‘জ্যোতি’ (১৯৮৮) ছায়াছবিতে কিশোরের ‘পারি না সইতে… ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া’, ‘আগুন’ (১৯৮৮), ‘আমার তুমি’ (১৯৮৯) ছায়াছবির ‘বলছি তোমার কানে কানে’, ‘হীরক জয়ন্তী’ (১৯৯০) ‘কথা দিলাম’ (১৯৯১), ‘গুপী বাঘা ফিরে এল’ (১৯৯২), ১৯৯৬ সালের দুটি ছবি ‘ভয়’ ও ‘লাঠি’, তাছাড়া ‘বিয়ের ফুল’ (১৯৯৬) ছবিগুলিতে কিছু উল্লেখযোগ্য গান ছিল। এর পূর্ববর্তী দুই দশকের বাংলা সিনেমার গানের সাথে তুলনা করলে, বলতেই হয় ‘সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল…’
আবার ব্যান্ডের গানের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। প্রাথমিক অচলায়নজনিত বিকর্ষণ কাটিয়ে উঠে কয়েক প্রজন্মের নস্টালজিয়ার বড় অংশীদার হয়ে ওঠে আরো কয়েকটি ব্যান্ড— ক্রসউইন্ডস, পরশপাথর, লক্ষ্মীছাড়া, একলব্য, দোহার ইত্যাদি তার মধ্যে অন্যতম। ইন্দ্রনীল, শ্রীকান্ত, রূপঙ্কর, শুভমিতা, মনোময়, রাঘব, লোপামুদ্রা, জয় সরকারের পাশাপাশি এঁদের গানও মঞ্চ মাতিয়েছে যথেষ্টই। গান বলতে বাঙালি যখন বুঝতো হয় ‘স্বর্ণযুগে’র গান নতুবা সমসাময়িক হিন্দি ছবির গান, তখনই একের পর এক বাংলা ব্যান্ড তোলপাড় তোলে বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে। নব্বইয়ের দশকে বাংলা ছায়াছবির প্রতি একটা অদ্ভুত বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছিল শিক্ষিত জনরুচিতে। সেইসময় কলেজ ফেস্টের গানই কখন যেন বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক ও বিস্ময়কর চমক হয়ে হাজির হল চন্দ্রবিন্দুর মাধ্যমে। যদিও অভিযোগ আছে, বিশ্বজোড়া গানের সিন্ধু, ঝেঁপে দিল চন্দ্রবিন্দু। উদাহরণ—
১/ ‘জুজু’ গানটির সুর এসেছে Harry Belafonte -এর ‘Kwela’ থেকে,
২/ ‘বন্ধু তোমায়’ গানের সুর এসেছে, Freddy Fender এর ‘Before The Next Teardrop Falls’ থেকে,
৩/ ‘ব্রহ্মা জানেন’— গানটি ‘Hotel Rwanda’ সিনেমার শুরুতেই শুনতে পাবেন, এসেছে Yvonne Chaka Chaka-এর ‘Umqombothi’ গানটির সুর থেকে,
8/ ‘আমার ভূত সব নিখুঁত’ গানটি এসেছে The Carpenters শিল্পীদ্বয়ের ‘Jambalaya’ (On The Bayou) গান থেকে। এরকম খুঁজলে আরো পাওয়া যাবে।
সে যাই হোক, ‘সুপারহিট মুকাব্বলা’ বা ‘চিত্রহার’ থেকে চন্দ্রবিন্দুর গান কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছিল। উপল, চন্দ্রিল, অনিন্দ্যরা তখন স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই গান বাঁধতেন তাঁরা। পরে বাংলা বর্ণমালার শেষ অক্ষর আর বাংলার অমর ছড়াকার সুকুমার রায়ের কালজয়ী কাহিনি ‘হযবরল’-এর একটি উক্তি মিলেমিশে গিয়ে ব্যান্ডের নামকরণ হল। ২০০০ সালের আগে অবধি মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁদের অ্যালবাম— ‘আর জানি না’ (১৯৯৭), ‘গাধা’ (১৯৯৮), ‘ত্বকের যত্ন নিন’ (১৯৯৯)। পরবর্তীতে সিনেমার গানেও তাঁদের বিশেষ অবদান সর্বজনস্বীকৃত। একদম সহজ-সরল সুরে, বহু আদুরে কথা জুড়ে একটি গান ‘জুজু’ অ্যালবামের ‘মন... হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম’— গানটা বড্ড প্রিয় ছিল সেসময়—
‘আদরের ডাক যদি মোছে
এই নাও কিছু ঘুম পাড়ানি গান আলগোছে
বোঝোনা এটুকু শিলালিপি!
মন রে…
ব্যাথার আদরে অবুঝ আঙ্গুল রাখলাম!’— হাওয়ার ওই ‘শিরশিরানি’ বুকের মধ্যে অনুভব না করে উপায় ছিল না শ্রোতার।
সিধু-পটা-বৈদূর্য-সম্রাট মুখার্জিদের রক ব্যান্ড ‘ক্যাকটাস’-এর প্রথম অ্যালবাম বের হয় ‘সারেগামা’ থেকে, নাম ছিল ব্যান্ডের নামে— ‘ক্যাকটাস’। ‘শুধু তুমি এলে না’, ‘তুমিও বোঝো আমিও বুঝি’, ‘ইছামতী’, ‘হলুদ পাখি’ গানগুলি খুব জনপ্রিয় হয়, এফ.এম. চ্যানেলে এই গানগুলি শোনার জন্য সেসময় মুখিয়ে থাকত দর্শক। ক্যাকটাস-এর পরের অ্যালবামগুলি সবই ২০০০ সালের পর মুক্তিপ্রাপ্ত। প্রভাবশালী বাংলা ব্যান্ডগুলির অন্যতম দুটি ব্যান্ড— ‘ভূমি’ ও ‘ফসিলস্’, কিন্তু সৌমিত্র-সুরজিৎ-এর লোকগানের দল ‘ভূমি’-র প্রথম ক্যাসেটের মুক্তি বা, স্টেজ শো— সবই মূলত ২০০০ বা তারপর। রূপম ইসলামের ‘ফসিলস্’-এর গানের ক্যাসেটও প্রথম মুক্তি পায় ২০০২ সালে। তাই এগুলি আলোচনার বাইরেই রাখতে হচ্ছে।
ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ— তিন প্রতিবেশী দেশেই প্রায় কাছাকাছি সময়ে ব্যান্ড নিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘মাইল্স্’ এর জন্ম ১৯৭৯ সালে। মাইলসের সদস্য হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদের বাবা কমল দাশগুপ্ত আর মা প্রথিতযশা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগম। ব্যান্ডটি ডিপ পার্পল, সান্তানা, পিংক ফ্লয়েড এবং বিটল্স ব্যান্ডের সংগীতের দ্বারা প্রভাবিত। ১৯৮২ সালে তাঁদের প্রথম অ্যালবাম বেরোয় ইংরেজিতে ‘মাইল্স্’ নামেই। এরপর একে একে ‘প্রতিশ্রুতি’, প্রত্যাশা’, ‘প্রত্যয়’, ‘প্রয়াস’, ‘প্রবাহ’ (২০০০) প্রভৃতি অ্যালবাম মুক্তি পায়। বাংলাদেশের আইয়ুব বাচ্চু ১৯৯২-তে প্রথম অ্যালবাম আনছেন, জেমস আবার ব্যান্ডের পাশাপাশি ‘অনন্যা’ (১৯৮৯), ‘পালাবে কোথায়?’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনি দুঃখ কোরোনা’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯)— এর মতো হিট অ্যালবামে সাফল্যের সঙ্গে তার সোলো ক্যারিয়ারও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তানের ‘জুনুন’ সুফি-রক ব্যান্ড, তারা তাদের অ্যালবাম ‘জুনুন’ আনছে ১৯৯১-তে, তার দুবছর পরে আসছে তাদের ‘তলাশ’। কিংবা পপ-রক-ব্যান্ড ‘স্ট্রিংস’-এর কথাও ভুললে চলবে না। ১৯৯০-তেই পাকিস্তানের এই ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম বাজারে আসে। ড. পলাশ সেন, দেবজ্যোতি ভাদুড়ি, রাকেশ ভরদ্বাজ প্রমুখের ইউফোরিয়া (Euphoria) ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটছে ১৯৯৮ সালে, অ্যালবামের নাম ‘ধুম’। আমাদের ব্যান্ডগুলো ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল সেসব গানের দ্বারা৷ পরবর্তীতে ‘শহর’ কিংবা ‘ফসিলস’-এর গানে সেই ধারণা পাওয়া যায়৷ রেকর্ড-লং প্লে থেকে ক্যাসেট হয়ে এম.পি.থ্রি এল বাজারে, এরপরই শুরু হল প্রবল পাইরেসি। এগুলো সবই কিন্তু সংগীতের দুনিয়ায় বিপুল প্রভাব ফেলল। মানুষ গান শুনবে কিন্তু আর ডিভিডি কিনবে না— এই এখন বাজারের অবস্থা। মৌলিক গান এভাবেই প্রায় শেষ হয়ে গেল। ইউটিউবে এখন সবাই রাজা। তবুও আজ যখন মাইলসের ‘ফিরিয়ে দাও’ (‘নিঃস্ব করেছ আমায়’) ‘একঝাঁক ইচ্ছে ডানা’ (পরশপাথর ও শহর)— এর মতো গানের পাশাপাশি মৌসুমী ভৌমিক শুনি, মনে হয় ইনি কোথাও আলাদা, এক্কেবারে আলাদা— মৌসুমী ভৌমিকের কথা বলে এই প্রবন্ধের ইতি টানবো—
‘... আমি শুনেছি তোমরা নাকি
এখনও স্বপ্ন দেখ, এখনও গল্প লেখো
গান গাও প্রাণভরে
মানুষের বাঁচামরা
এখনও ভাবিয়ে তোলে
তোমাদের ভালবাসা এখনও গোলাপে ফোটে!’ (গান : ‘স্বপ্ন দেখব বলে’)— এই গান একেবারে প্রাণের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে। সংগীত শিল্পী, গীতিকার, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, আর্কাইভিস্ট, ফিল্ড রেকর্ডিস্ট ও গবেষক মৌসুমীর ‘এখনো গল্প লেখো’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। আমেরিকার কবি ও সমাজ-কর্মী Allen Ginsberg-এর ‘September on Jessore Road’ (১৯৭১) কবিতার ভাবানুবাদ ‘যশোর রোড’ তাঁর কণ্ঠে যেন মুক্তিযুদ্ধের সমার্থক হয়ে ওঠে। এই গান যখনই শুনি, মনে হয় এ যেন বহু পুরাতন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রেকর্ড’ গল্পের সেই আশ্চর্য রেকর্ডের মতো যার সুর রক্তের মধ্যে মিশে আছে— ‘অনন্য’ সেই গানের পংক্তি ও সুর—
‘তুমি বলেছিলে সেই দিন, সেই ব্যাস্ত সকালে,
এসো নিশ্চয় এসো একবার আমাদের মিছিলে।
তাই ইচ্ছে হল জানতে কীভাবে দাবির কথা তুলে,
কেমন সবাই হাত ধরে ধরে গান গেয়ে পথ চলে।
এসে দেখি আমি, ধর্মতলার চার কোণে চার দল,
সব নানা সুরে বলে একই কথা, আমার সঙ্গে চল।
এতো শব্দ এতো চিৎকার তবু কি নিদারুন দৈন্য,
একই শ্লোগানে নানা গন্ধ তুমি কোথায় ছিলে অনন্য?’ (গান : ‘অনন্য’ / মৌসুমী ভৌমিক)
তথ্য-ঋণ :
1. ‘হ্যালো 90’s’ : রবিবাসরীয় প্রবন্ধ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১8।
2. বাংলা ভাষা ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ইতিহাস (প: ব: উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ) ।
3. ‘নতুন গানের ভোরে’ ওয়েবসাইট [http://natungaanerbhore.blogspot.com/ ]
4. ‘বন্ধু কী খবর : ‘আরও একবার মঞ্চে সুমন-অঞ্জন’ [মনীষা দাশগুপ্ত, m.femina.in]
উইকিপিডিয়া (Wikipedia)
ছবি : সংগৃহীত
Comments