[ একজন ভণ্ড সন্ন্যাসী ধ্যানে বসেছে। তার চ্যালা পাশে বসে বাতাস করছে। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে দেখছে, পথে কেউ আসছে কিনা! সন্ন্যাসী ধ্যান করতে করতে মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে ‘ব্যোমকালী তোল খাঁড়া… শিবশম্ভু জয় তারা’ বলে উঠছে। সামনে কমণ্ডলু থেকে হাতে জল নিয়ে প্রথমে নিজের মাথায় ছিটোচ্ছে, তারপর চ্যালার গায়ে দিচ্ছে। চ্যালা এরমধ্যেই আবার গুনগুন করে গান গাইছে।]
চ্যালা – বড়ো ইচ্ছে করছে আজকে
শুধু মাটন পোলাও খেতে
খালি একটা মুরগি জুটলে হয় উপায়
জানি মিলবে ইলিশ চিংড়ি
সাথে মিলবে কাবাব টেংড়ি
মুরগিকে আজ ডাকছি, কাছে আয়
কাছে আয়… মুরগি কাছে আয়…
কাছে আয়… মুরগি কাছে আয়! ( ‘বোঝে না সে বোঝে না’ গানের সুরে )
গুরু – এই মূর্খ! এমন গাঁক গাঁক করে চিল্লালে মুরগি আসবে! সে তো তোর গান শুনে অন্য পথে পালাবে।
চ্যালা – তাই না গুরুদেব! আসলে কী বলুন তো… এই খিদে বড়ো বালাই। একবার চেপে বসলে আর খেয়াল থাকে না। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যাই… সরি স্যর!
গুরু – এই ব্যাটা ছুঁচো! খামোখা স্যর বলছিস কেন এখন! কেউ একটা শুনলে তো আর রক্ষে থাকবে না! ব্যোম তারা…
চ্যালা – এই দেখেছেন! আবার ভুল হয়ে গেছে! বলছি গুরুদেব, আপনার কাছে কিছু আছে নাকি?
গুরু – কী থাকবে?
চ্যালা – না মানে, সামান্য অর্থ! তাহলে দূরের ওই দোকান থেকে একটু নিয়ে আসতাম।
গুরু – কী নিয়ে আসতি?
চ্যালা -ইশশ! আপনার সামনে বলতে কেমন নজ্জা লাগে!
গুরু – আহ! ন্যাকা… বলো না বাপধন… দুবোতল বাংলা খেয়ে বাংলা মায়ের সন্তান বাংলার সেরাদ্ধ করবে!
চ্যালা – ধুর! কী যে বলেন না স্যর, এই থুড়ি গুরুদেব।
গুরু – চোপ বেজি কোথাকার! চুপ করে এখানে বসে আমার সঙ্গে মন্ত্র বলো…
চ্যালা – মন্ত্র বললে ক্লায়েন্ট আসবে?
গুরু – আসবে মানে! দৌড়ে দৌড়ে আসবে!
চ্যালা – বেশ বেশ আপনি শুরু করুন…
[ চ্যালা গুরুর সামনে বসে চোখ বুজে দুহাত তুলে নমস্কার করে। গুরু মন্ত্র পড়া শুরু করে… ]
গুরু – ওং… ব্যোম… জয় তারা… পাপহারিনী… বিপদনাশিনী… ছটফট!
ওং ক্রিং… খ্রিং… শম্ভু… ভোলে… কপাল খোলে ঝটপট
ওং… বিষ্ণুমাতা… ব্রহ্মাপিতা… হটপট
ওং অর্থম… অনর্থম… দাও চটপট!
চ্যালা – চটপট… ঝটপট… হটপট… ছটপট
দাও অর্থম… পাও শান্তিম…
চটপট… ঝটপট… হটপট… ছটপট
[ পথ দিয়ে সেইসময় পার হচ্ছিল এক যুবক। যুবককে আড় চোখে দেখে গুরু শিষ্যকে বলে ]
গুরু – শিষ্য! পথ দিয়ে কোনো দুঃখী মানুষ একা একা চলেছে?
চ্যালা – বাবা! এক যুবক…
গুরু – নিয়ে এসো তাকে…
চ্যালা – ছটপট ছটপট ছেলে, তোমার নামটা জানতে পেলে, বাবা কমিয়ে দেবে শোক, আহা তোমার ভালো হোক!
ছেলে – আজ্ঞে আমার নাম আনন্দ।
চ্যালা – এ বি (পি বলতে যায়, গুরু বলে দেয়)
গুরু – সি ডি জানো?
ছেলে – জানব না কেন?
গুরু – এই এ বি সি ডি, সেই এ বি সি ডি নয়! এ হল জীবনের এ, বি, সি, ডি!
ছেলে – কীসব বলছেন বলুন তো!
গুরু – তোমার কপালে একটা জ্যোতি আছে, তুমি জানো!
ছেলে – আমার কপালে! ধ্যার… রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াই। কোনোদিন দেখিনি!
গুরু – সেইজন্যই তুমি আমার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছ! জানলে আমি তোমার উল্টোদিকে দাঁড়াতাম!
ছেলে – আজ্ঞে আপনি হিসেবমতো আমার উল্টোদিকেই আছেন। খালি বসে আছেন!
চ্যালা – আহ! বাবার মুখে মুখে কথা বোলো না বাছা! শোনো বাবা কি বলে…
গুরু – তোর ভাগ্যে প্রচুর ধনযোগ রয়েছে।
ছেলে – কী!
গুরু – ঘাবড়াস নে! আমি যখন বলছি, তখন তুই একদম নিশ্চিন্ত থাক!
ছেলে – আমি কি লটারি কাটব?
গুরু – ধীরে বৎস ধীরে! শিষ্য, ওকে বসতে দাও।
চ্যালা – আজ্ঞে।
ছেলে – কোথায় বসব আবার? এই আপনার মতলবটা কী বলুন তো!
চ্যালা – আরে… তুমি বোসো না! তোমার জ্যোতি পরীক্ষা হবে।
ছেলে – কী মুশকিল! আমি খুব ভালো দেখতে পারি। আমার এসব পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই।
গুরু – সে তো আর তুমি ঠিক করবে না বাছা…
চ্যালা – ধনযোগ তো তোমারই আছে, তাঁকে একটু জেনে নেবে না!
গুরু – বোসো।
[ ছেলেটি বসে। গুরু কমণ্ডলু থেকে জল ছেটাচ্ছে, আর বলছে ]
গুরু – ওং ক্রিং… ম্রিং লিং… অর্থ পাবে রাশি রাশি
ভ্রুম ভ্রুম… ফুচার ডুম… হবে নাকো ফুটবে হাসি
সঙ্গে যদি থাকে টাকা, যজ্ঞ হবে, দাও আহুতি
এই টাকা গেলে পরে তোমার হবে নাকো ক্ষতি।
যজ্ঞ হবে, টজ্ঞ হবে, দাও তুমি অর্থাহুতি
মিলবে টাকা, চলবে চাকা… দেখতে পাচ্ছি তোমার জ্যোতি
সুখসাগরে ভাসবে তুমি, হবে নাকো কোনো ক্ষতি
দাও অর্থাহুতি… দাও অর্থাহুতি… দাও অর্থাহুতি!
[ এইসব বলতে বলতে গুরু যুবকের চুল ধরে নাড়াতে থাকে। যুবকের লাগে, চিৎকার করে ওঠে। ]
ছেলে – কত?
গুরু – দক্ষিণা মাত্র ১০৮০০ সঙ্গে ১৮% gst!
ছেলে – ও বাবা! আপনি আবার ১৮% GST ও নেন!
চ্যালা – নিতে হয় ভাই… সরকারের বলেছে, দেশের বিরুদ্ধে তো আর যাওয়া যায় না!
ছেলে – বটেই তো… তাহলে সব মিলিয়ে কত হল বলুন তো?
গুরু – (চোখ বুজে) ১২৭৪৪/-
চ্যালা - রাউন্ড ফিগারে ১২৭৪০।
গুরু – শান্তি… জগৎ শান্তি…
ছেলে – তা আমার যে এই জ্যোতি বেরোচ্ছে, তা দিয়ে আমার কীরকম ধনযোগ হতে পারে? আপনার কোনো ধারণা আছে?
গুরু – না জেনে এই বাবা কথা বলে না!
চ্যালা – একদম বলে না।
গুরু – না বুঝে এই বাবা কোনো জ্ঞান দেয় না বাছা।
চ্যালা – একদম দেয় না!
গুরু – তুমি ফুট কেটো না, তাহলে আজ কোনো দেশি জিনিস খেতে পরতে পারবে না!
চ্যালা – দুঃখিত বাবা।
ছেলে – বলুন বাবা…
গুরু – আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তুই পাবি একদিন লাখো লাখো ধনরাশি!
ছেলে – তাও, কতদিন পর?
গুরু – দেখি… (চোখদুটো ভালো করে দেখে। একটা বড়ো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে)
ইশশ আরেকটু আগে আমার সাথে দেখা হলে তোকে কোটি কোটি পাইয়ে দিতাম। এই তো কদিন আগেই দুজন কোটি পেয়েছে। আজ তারা সুখী…
চ্যালা – হ্যাপি ক্লায়েন্টস…
ছেলে – আপনাকে টাকা দেওয়ার কতদিন পর আমি লাখোপতি হব?
চ্যালা – ধরে নে হয়ে গেছিস!
ছেলে – আজ্ঞে না, এই ধরার ব্যাপারে আমি খুব কাঁচা। কে সি নাগের অঙ্কে যতবার কিছু ধরেছি, ততবারই তা ভুলের দিকে গেছে… বামপক্ষ কোনোদিন ডানপক্ষের সাথে মেলেনি। যদিও বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। তারচেয়ে আপনি নির্দিষ্ট করে বলুন।
চ্যালা – বাবা, ছেলে আমাদের পিন পয়েন্ট বল পেন! পয়েন্টে পয়েন্টে প্রশ্ন করছে তো। ( বাবাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে)
গুরু – শোন, তুই লাখোপতি হবি সামনের অমাবস্যা পেরিয়ে যে পূর্ণিমা আসবে, সেই পূর্ণিমায়। মহুয়াবনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদের আলোয় দেখবি একটা মাটির ঢিবি। সেই ঢিবির নিকটে পৌঁছনোর পরে তুই লাখোপতি হওয়ার আন্দাজ পাবি। এটুকু বলতে পারি।
চ্যালা – ওখানে কী টাকা আছে বাবা? (ফিসফিস করে)
গুরু – মূর্খ!
ছেলে – আমার কাছে তো ক্যাশ নেই।
চ্যালা – জিপে, ফোনপে আছে?
ছেলে – বাবা দেখছি খুবই advance!
গুরু – আর কী! যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে তো বাঁচা দায়, বাবা!
চ্যালা – QR Code সঙ্গে আছে। চিন্তা নেই কিছু। স্ক্যান করুন, টাকা দিন, টাকা পান। খুশি থাকুন।
ছেলে – হুম্ম… কিন্তু টাকা দেওয়াতে যে একটা ছোট্ট সমস্যা আছে গুরুদেব!
চ্যালা – কী সমস্যা আবার!
গুরু – কী হয়েছে বৎস! তুমি কী বিশ্বাস করতে পারছ না!
ছেলে – আজ্ঞে না! টাকা পাওয়ার জন্য, বা কিছু একটা পাওয়ার জন্য জন্য যদি টাকা দিই, তাহলে যে আমার বদনাম হয়ে যাবে! একজন ইডি অফিসারের পক্ষে কি সেটা শোভা পাবে?
গুরু – মানে?
চ্যালা – প্রভু ইডি!
গুরু – বিসিডি! পালা… মদন পালা…
[ গুরু, চ্যালা পালাতে যায়। ছেলেটা বন্দুক বের করে। ]
ছেলে – পালানোর চেষ্টা করবেন না পুণ্যশ্লোক বাবু। আপনাকে আমি আগেই চিনেছি। বহুদিন ধরে এই বুজরুকি কারবারে আপনি নেমেছেন। অনেকদিন ধরে আপনি টার্গেটে ছিলেন। কিন্তু যুতসই প্রমাণ পাচ্ছিলাম না। আজ পাখি নিজে এসে ধরা দিল। চলুন… মামাবাড়ি ঘুরে আসবেন চলুন। ওং… ক্রিং।। ঝটপট… হাজতবাস চটপট!
আপনারা কী দেখছেন? ভবিষ্যতে বুজরুকি বাবা, সাধু, সন্ন্যাসীর থেকে সাবধান। কর্ম ছাড়া অর্থ মেলে না। আর মিললেও ভবিষ্যতে পাবলিকের জুতোর মারও মেলে, সাবধান।
সবাই সাবধান!
- সমাপ্ত -
ক্যালিগ্রাফি : সর্বজিৎ সরকার
Comments