বিশিষ্ট অনুবাদক ও সাহিত্য সমালোচক শ্রী অভিজিৎ মুখার্জি (Abhijit Mukherjee) শুভদীপ বড়ুয়ার উপন্যাস, 'নিঃশব্দ পাহাড়' নিয়ে একটি গুুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন, 'সময় ভূখণ্ড আখ্যান' নামে। সেই আলোচনার অংশবিশেষ এখানে তুলে দেওয়া হল:
একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে সাহিত্যের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হল একটা সময়কে ধরতে পারা। ‘সময়’ বলতে মোটামুটি ভাবে একটা পরিস্থিতির কথাই বোঝান হয় সেক্ষেত্রে। কিন্তু বড় লেখকরা সময়কে ধরতে চেয়ে শুধু কিছু পরিস্থিতিগত খুঁটিনাটি নয়, সময় জিনিসটা সম্বন্ধে তাদের ধারণাকেও লেখায় এনে ফেলেন। মানুষের মনের মধ্যে সময় সম্বন্ধে ধারণার অনেক গলিঘুঁজি, গোলোকধাঁধা রয়ে যায়। সেগুলোর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া লেখায় না থাকলে সেই লেখা হয়ে পড়ে নেহাতই সাংবাদিকতাধর্মী, কোনও উচ্চ মানে পৌঁছোয় না।
শুভদীপের লেখায় যে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট, সেটা হল, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত বিস্মৃতির উর্দ্ধে উঠে ইতিহাসের নানা উপাদান যেন একটা পটে আঁকা হয়ে থাকে। কার্য-কারণের সম্পর্কের একটা কোনও রাজনৈতিক মতবাদ এই উপাদানগুলোকে তার ইচ্ছে মত পরম্পরায় গেঁথে ইতিহাসের একটা ব্যাখ্যা বা খতিয়ান তৈরি করতেই পারে, কিন্তু পটচিত্রটা থেকেই যায়, যাতে ভিন্নতর নানা দৃষ্টিভঙ্গিরও নিজেদের মত করে সেই উপাদানগুলোকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে, প্রদর্শন করে তাদের দৃষ্টিকোণগুলোকে প্রতিষ্ঠা করার স্বাধীনতাও থেকে যায়। শুভদীপের এই উপন্যাসের আখ্যানপ্রণালীকেও সেরকম একটা প্রয়াসের উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
মনে আছে, বোর্হেস তাঁর গল্প ‘আলেফ’ শুরু করেছিলেন লেভিয়াথান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে : But they will teach us that Eternity is the Standing still of the Present Time, a Nunc-stans (as the Schools call it); which neither they, nor any else understand, no more than they would a Hic-stans for an infinite greatness of Place. (Leviathan, IV : 46)
বোর্হেস ঐ গল্পে লিখছেন : সেই পরিমাপহীন, অসীম মুহুর্তে আমি প্রত্যক্ষ করলাম লক্ষাধিক চমৎকার ও ভয়ঙ্কর জিনিস; সেগুলোর কোনওটাতেই আমি ততটা আশ্চর্য হইনি যতটা হলাম এই কারণে যে সবগুলো ঘটছে একই বিন্দুতে, কোনও সমাপতন নেই, কোনও স্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে নয়। আমার যা যা চোখে পড়লো তা সবই ঘটছে একই সঙ্গে, অথচ লিখতে গেলে কিন্তু, একটার পর আরেকটা, এভাবে লিখতে হবে, কেননা ভাষা জিনিসটা পরম্পরা অবলম্বন করে। তবুও এর কিছুটা আমি ধরতে চেষ্টা করছি। সিঁড়ির নিচে, ডানদিকটায়, দেখতে পেলাম একটা প্রায় অসহ্যরকম উজ্জ্বল রামধনু রঙের গোলক। প্রথমে মনে হয়েছিল পাক খাচ্ছে ওটা ; তার পরেই টের পেলাম যে পাক খেতে দেখাটা একটা বিভ্রম। ওটার মধ্যে যে ঘোর লাগিয়ে দেওয়ার মত অত্যাশ্চর্য দৃশ্যাবলি তাতেই এই বিভ্রম। আলেফের ব্যাস হবে দুই কি তিন সেন্টিমিটার, কিন্তু বিশ্বজগতের পুরো পরিসরটাই ধরা আছে ওর ভেতরে, কোনও জিনিসকেই মাপে একটুও ছোট না করেই। প্রত্যেকটা জিনিসেই (যেমন ধরা যাক, একটা আয়নার কাচের উপরিতলটা) অজস্র জিনিস, কেননা মহাবিশ্বের যেকোনও বিন্দু থেকেই আমি ওটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। দেখলাম সমুদ্রে এটা ওটা গিজগিজ করছে, ভোর দেখলাম, গোধূলি, একাধিক অ্যামেরিকা, একটা কালো পিরামিডের একেবারে কেন্দ্রে একটা রূপোলি মাকড়সার জাল, একটা ভাঙাচোরা গোলোকধাঁধা (লন্ডন শহর ওটা), একের পর এক অন্তহীন চক্ষু, সব খুব কাছাকাছি, আমার মধ্যে নিজেদের নিরীক্ষণ করছে যেন আয়নায় দেখছে, এই গ্রহের যাবতীয় আয়না চোখে পড়লো (কিন্তু কোনওটাতেই আমি প্রতিফলিত হচ্ছি না) না) … থোকাথোকা আঙুর, তুষার, তামাক… জলীয় বাস্প, বিষুবরৈখিক উত্তল মরুভূমি সমূহ এবং তাদের প্রতিটি বালিকণা, দেখতে পেলাম ইনভারনেসের এক নারীকে যাকে আমি কোনওদিন ভুলবো না … উপাদেয় বিয়াত্রিচ ভিতেরবোর দেহাবশেষ, দেখলাম আমার শরীরের গাঢ় রক্তের প্রবাহ … আলেফকে দেখতে পেলাম একই সঙ্গে সব যায়গা থেকে, আলেফের মধ্যে পৃথিবীকে দেখলাম, আবারও একবার দেখলাম পৃথিবীর মধ্যে আলেফ ও আলেফের মধ্যে পৃথিবী…
'নিঃশব্দ পাহাড়' উপন্যাসটাতে স্যাম পিটার্স নামে এক মার্কিনী যুবকের বিবরণীতে আমরা উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে আফঘানিস্তানের নানা প্রসঙ্গ ও পরিস্থিতি নিয়ে পড়ছি। সেই বিবরণীর অবশ্যই একটা শুরু আর একটা শেষ আছে, কিন্তু পাঠক উপন্যাসটা পড়া শেষ করে খেয়াল করবেন তাঁর চিন্তা জুড়ে রয়ে গেছে কাহিনীর কাঠামোটির বদলে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন সময়ের আলাদা আলাদা অজস্র ছবি! সারা পৃথিবীর নানা কোণের ছবি, ইতিহাসের নানা সময়ের ছবি। যদি বোর্হেসের উদ্ধৃতি মত একটা অখন্ড বর্তমানের ধারণা করতে হয়, যেই বর্তমানই ধারণ করে রাখে সমস্ত ইতিহাসকে তাহলে ভাষার পক্ষে সেই সময়ের ছবি আঁকা কঠিন, সেই অখন্ডতায় সামিল হওয়া কঠিন, কারণ ভাষার ব্যবহার, বাক্যের অবস্থান ক্রমিক। তবু মনস্তাত্ত্বিক স্তরে এধরণের কাহিনীর দ্যোতনাকে কোনও একটা বিশেষ অঞ্চলের, কোনও একটা বিশেষ সময়ের আদলের মধ্যে বেঁধে ফেলার চেয়ে ব্যর্থতা আর কিছুই হতে পারেনা। লক্ষ্য করতে হয়, অত্যন্ত সচেতন ও সুচতুর ভাবে ভাষাকে রাখা হয়েছে সংস্কৃতির নির্দিষ্টতার থেকে একটু বিচ্ছিন্ন করে। বাংলায় লেখা উপন্যাস হয়ে যেতে পারতো বাঙালির চোখে দেখা ইতিহাস যদি না বাবা কিম্বা মায়ের পরিবর্তে ব্যবহার করা হত পিতা আর মাতা, অমাবস্যা, পূর্ণিমার পরিবর্তে যদি না বলা হত চন্দ্রহীন রাত্রি, পূর্ণচন্দ্রের রাত্রি। বোর্হেস যে লিখেছিলেন : ভাষা জিনিসটা পরম্পরা অবলম্বন করে— অনেকগুলো পরম্পরা পিছিয়ে গিয়ে একটা ইতিহাসের সঙ্গে মানসিক যোগসাধন করতে এভাবেই একটা প্রতীকি আভাস তৈরি করে রাখা হল যাতে করে উপন্যাস পড়ার সময় পাঠক আর নেহাতই একবিংশ শতকের বাঙালি পাঠক নন, গল্পও নেহাতই এক মার্কিনীর বলা আফঘানিস্তানের পটভূমির কাহিনী নয়।
কথা হল, উপন্যাসের ন্যারেটিভকে এমন বন্ধনহীন, বর্ণালির মত রকমারির সমাহার করে ব্যবহার করলেন কেন লেখক, কেন এই অজস্রের সমাহারের অখন্ড ছবির চমকপ্রদ কৌশল? এই জটিল, বহুস্তরীয়, দুরূহ প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে আছে কি কোনও নির্দিষ্ট দর্শন? আসুন দেখি বৌদ্ধ মহাযান তত্ত্বে সৃষ্টির কী চিত্র ব্যাখ্যা করা হচ্ছে!
জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ অসঙ্গ তাঁর মহাযানসমপরিগ্রহ শাস্ত্রে ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা’ বা ‘শুধুমাত্র চেতনা’ ভাবটির উপস্থাপনা করেন। সেখানে বলা হচ্ছে যে এমনিতে জীবন চালিত হয় ছ’টি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে : রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ ও চিন্তা। কিন্তু ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা’ স্কুল বা দর্শনবংশ চালু করলো সপ্তম একটি নতুন বোধ : মনস্ , যা ধারণ করে রেখেছে সেই সমস্ত মানসিক ক্ষমতাকে যেগুলোর মাধ্যমে আত্ম ও ব্যক্তি পরিচয়ের ধারণা করা যায়। শুধু এটুকুই নয়, এই দর্শন থেকে পাওয়া যায় ‘অলয় বিজ্ঞান’ বা সর্বোচ্চ চেতনার কথাও। এই ‘অলয়’ বস্তুজগতের যাবতীয় ‘বীজ’কে সংরক্ষণ করে।
আমরা এই সীমিত অবকাশে তত্ত্বের খুব গভীরে যাওয়া থেকে বিরত থাকবো। এটুকু বলা যায়, এই অলয় চেতনাই যে জগতে আমরা বাস করি সেই মায়াটির সৃষ্টি করে। যাবতীয় জ্ঞানের উৎস যখন অনুধাবনযোগ্য যাবতীয় কিছুকে স্পর্শ ও আলিঙ্গন করে তখন এই বস্তুজগতের জন্ম হয়। আমাদের যে আত্মচেতনা আর আমাদের আত্মা দুইই জন্ম নিয়েছে অলয় চেতনা থেকে এবং উভয়েই ফিরে যায় অলয় চেতনাতেই।
মহাযান তত্ত্বে, বিশেষত ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা’ দর্শন-বংশে এই জগতকে বর্ণনা করা হচ্ছে এক নিরন্তর স্রোত-প্রবাহ হিসেবে। প্রবাহটা স্থির কিন্তু জলকণা পালটে যাচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। এই জগতও তেমনই প্রতি মুহুর্তে জন্মাচ্ছে ও লয় পাচ্ছে। অতীতে কিম্বা ভবিষ্যতে অস্তিত্বের কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ থাকে না। শুধু এই বর্তমান মুহুর্তটি, যখন কিনা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়, চোখ দিয়ে দেখা যায়, হল বাস্তব। বাস্তবতা শুধু বর্তমানেই লভ্য, অতীত ও ভবিষ্যত বলে কিছু নেই।
বুদ্ধ একটি কবিতার আকারে শিক্ষা দিয়েছিলেন :
সমস্ত ধর্মই বিধৃত হয়ে আছে চেতনায়
আর চেতনা ধরা আছে সার্বিক ধর্মে
দুটোই পরস্পরের কারণ
দুটোই পরস্পরের ফল।
বিজ্ঞপ্তিমাত্রতা তত্ত্বে কার্য ও কারণ ঘটে অভিন্ন সময়ে অথচ একাদিক্রমে।
এই উপন্যাসের ন্যারেটিভ এইভাবেই যাবতীয় কার্য ও কারণের এমন একটা ক্যালিডোস্কোপিক মহাচিত্র অখন্ডভাবে পাঠকের চেতনায় স্থাপন করে যে বলা যায়, একটাই বিশাল মানচিত্র যা সময়কেও অখন্ড বর্তমান হিসেবে নিজের ভেতরে স্থান করে দেয়, বোর্হেসের ঐ আলেফের মত যেন এই উপন্যাসের ভেতর দিয়েও পাঠকের গোচরে আসছে। সময়ের যেকোনো একটি পর্যায় যে আসলে অন্য সব ক’টি পর্যায়ের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত এর মোক্ষম ইঙ্গিত আসে ঐ মরুচারি ইংরেজ বৃদ্ধের কাহিনীখন্ড থেকে। এক ব্রিটিশ সেনা ডাক্তার যিনি অংশ নিয়েছিলেন 1842 সালের প্রথম অ্যাংলো আফগান যুদ্ধে, 1978 সালেও যাকে খচ্চরের পিঠে চেপে আফঘানিস্তানের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। সেই যুদ্ধে বেঁচে গিয়েছিলেন যে জিনিসটির জোরে সেটা 1839 সালের একটা ম্যাগাজিন। টুপির ভেতর ঐ ম্যাগাজিনটাই আকবার খানের সৈন্যদের তরবারির কোপ থেকে ওঁকে রক্ষা করে। ঐ পত্রিকায় বেরোচ্ছিল তখন এডগার অ্যালান পো-র লেখা!
আজকের পৃথিবীতে ইতিহাস চর্চার দৃশ্যটাও তো একটা বিশাল পটচিত্রের বিন্দু থেকে বিন্দুর যোগ সাধন। ভূপৃষ্ঠের নানান যায়গা, নানা জনগোষ্ঠির বিচরণ, পাড়ি জমানোর ইতিহাস তো আসলে তাদের ভাষাগত বৈশিষ্টের ইঙ্গিত: অবলম্বন করে সময় ও পরিসরের অংকের সমাধান। উপন্যাসের গোড়াতেই আমরা আঁচ পাচ্ছি লেখকের সে-হেন দৃষ্টিভঙ্গির –
ঘুরেইজের নদীর নাম বলতে না পারলেও, সে হঠাৎই বিতস্তার নাম বলে ফেলাতে অবাক হয়েছিল দুরন। একই নদীর কত না নাম! এক দেশ হতে অন্য দেশে গেলে মানুষের নামও বোধকরি পালটে যায় আজকাল। বালকটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বিতস্তার নাম করেছিল ঠিকই তবে উর্দুতে। নামটি খুব সুন্দর করে উচ্চারণ করেছিল সে। দরিয়া-এ-জিলম। তার সর্বজ্ঞ অভিভাবক মিসরি’র সম্ভবত এই তথ্যটি জানা নেই যে বিতস্তা’কে এই দেশে কেউ জিলম বা ঝিলম বলে ডাকে না। কাশ্মীরে দু’পাড় ধরে বিস্তীর্ণ তটভূমিতে এই নদীর নাম বৈথ্। বৃদ্ধ দুরনের সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হয়েছিল যে ঐ বাবা-মা-ছেলে’র দলটি পাকিস্তান থেকে আসা।
যেসব দর্শন, সে রাজনৈতিক হোক কিম্বা ধর্মীয় হোক, এক্সক্লুসিভিস্ট অর্থাৎ ওরা-আমরা’র মধ্যে ‘ওরা’টার এমনকি অস্তিত্ব বজায় রাখার অধিকারটুকুও স্বীকার করে না, তাদের ফিউচারিস্টিক ভিশন থাকতে হয়, ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্ভরতা। এই সব দর্শনে আধুনিকতার দর্শনের মতোই সময়ের গতির ধারণা করা হয় জ্যা-মুক্ত তীরের মতো করে। সময় একটি সরলরেখায় যে পথে চলে যায় সে পথে আর ফিরে আসে না। সেই ভবিষ্যত স্বপ্নের সম্ভাব্যতা প্রতিষ্ঠা করতে এদের ইতিহাস চেতনাকে কিছু বিশেষ ধরণের শর্ত মেনে চলতে হয়, প্রায়শই ওঠে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ। এদের কাছ থেকে এই উপন্যাসের ইতিহাস চেতনার বিরোধিতাই আমি প্রত্যাশা করি। সেই যে ‘টেন ডে’জ্ দ্যাট শুক দ্য ওয়র্ল্ড’, তার যে বিবরণ আমরা জন রীডের ঐ নামের বইটাতে পেয়েছি সেটা এখানে ঐ ক’দিনের যে ছবি আঁকা হয়েছে তার সঙ্গে মেলে না— লেখক শুভদীপ বড়ুয়াকে এনিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে হয়। আফঘানিস্তানে রুশ অভিযান, তার প্রেক্ষাপট ও তার ফলশ্রুতি— যে ধারণা এই উপন্যাস পড়ে হবে তা ইসলামপন্থী বা উদারপন্থীদের স্বীকৃতি পাবে বলে মনে হয় না।মিশর থেকে শুরু করে আরবি, পারসিক এবং অবশ্যই আফঘানিস্তানের নানা অঞ্চলের ইসলামপূর্ব ইতিহাস, জনগোষ্ঠির ভূমিকা যেভাবে এ কাহিনীতে এসেছে তা আমাদের অভ্যস্ত চৌহদ্দির থেকে অনেক বেশি বিস্তীর্ণ ও বৈচিত্রময়— কৌতূহল হচ্ছে পাঠকের ও পন্ডিতদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে! অর্থাৎ জ্যা-মুক্ত তীরের যে মডেল আর এই উপন্যাসের সময়-দর্শন, এ দুয়ের বিচার, এ দুয়ের বিশ্লেষণ ভিন্ন।
গোঁড়া ইসলামী রাজনীতির আজ যে প্রতাপ আফঘানিস্তানের গণ-মানসে তাতে মনে হতে পারে সময় বুঝি বা তার হৃদ্স্পন্দন হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মাহিলদের বাড়িতে স্যামুয়েল পিটার্স দেখছে : দোলনাটা স্থির, কিন্তু কেউ যেন অদৃশ্য হাতে তাতে দোল দিচ্ছে মাঝে মাঝে,… সূক্ষ্ম এক দোলন আছে তার শরীরে, খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে তবেই বোঝা যায়, অনেকটা বদ্ধ ঘরের ভেতর খুব ধীরে পাতলা বাতাস বয়ে যাওয়ার মত, আমি সযত্নে লুকিয়ে রাখা একটি নির্জনতার আভাস পাচ্ছি যেন। নির্জন এক পরিসরের নির্জনতম স্থানাঙ্ক নির্দেশ করছে ঐ দোলনাটা।
একটা স্বপ্ন : একটা দাবার বোর্ডের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উটের কাফিলা। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য বলে বুঝিয়ে দিতে হয়না। ঐ দাবা খেলাটারই সূত্রে স্যামুয়েল পিটার্সের এই দূরদেশে আসা আর ইতিহাসের একটা বৃহত্তর দাবাখেলার নানা হকিকৎ সেই কাহিনী থেকেই প্রতিভাত হওয়া। লেখকের ইতিহাসের নানা পর্যায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতা বিষয়ে জ্ঞান নিয়ে আমি একটি কথাও খরচ করবো না। পাঠক আমার চেয়ে কিছুমাত্র কম টের পাবেন না। কিন্তু এই পরিস্থিতি উপলক্ষ করে দূরপ্রাচ্যের প্রজ্ঞা সম্বলিত ‘গো’ খেলার উপমা এনে অপরিণত স্ট্র্যাটেজি আর প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির ফারাক যেভাবে লেখক বোঝালেন, আমার অভিজ্ঞতায় এর নজির আগে আর পাইনি।
মিথ্ আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এদের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক নির্দেশ করতে একটা লক্ষ্য করার মত পরিষ্কার কাহিনীখন্ডের অবতারণা করা হয়েছে স্প্যানিশ পর্যটক হুয়ান দে ইতুর্বে-র কালোমুক্তোবাহী কারাভেল জাহাজের প্রসঙ্গ টেনে। ১৬১৫ সাল নাগাদ কোনও একসময়ে, একদিন প্রচন্ড সামুদ্রিক ঝড়ের পাল্লায় পড়লো ঐ জাহাজ। কালান্তক ঝড় তাকে উড়িয়ে এনে ফেললো অগভীর এক হ্রদে। শুকিয়ে যাওয়ার মুখে সেই হ্রদের থকথকে কাদায় আটকে গেল জাহাজ। বহুবার নাকি বহু মানুষ ঐ জাহাজটাকে দেখেছে কিন্তু কেউই তার কাছে যেতে পারেনি। বিংশ শতকের শেষে এসে একসময় স্যামের বন্ধু অ্যালেনকে জিজ্ঞেস করতে হল, “স্যাম ! লিটল ডুড। সত্তরের দশকে আবার জাহাজ ভিড়ছে কেন বলতো ?” আরেকটা ওরকমই জাহাজের আটকে যাওয়ার গল্প আছে, মরুভূমির গায়ে গায়ে, য়ুমার কাছাকাছি। অ্যালেন জিজ্ঞেস করেছিল,”আচ্ছা স্যাম, পারস্য কি কোনোদিন কলোনিয়াল ছিল?”
কী হবে তাহলে এই আফঘানিস্থান দেশটার পরিণতি, একই রকম চলবে চিরটাকাল? মনে রাখবেন, পাহাড় কিন্তু একটি phallic suggestion ও বটে, পিতৃতান্ত্রিকতার একটি মোক্ষম ছবি অবচেতনে। যতক্ষণ পাহাড় অটল আছে, সময়ও স্থির। আর কাহিনীতে ঘটছে দু দুটো অসীম তাৎপর্যময় মৃত্যু, পিতার মৃত্যু। একটি মাহিলের পিতার আর একটি সেই গোষ্ঠিপতি পিতার যাঁর মৃত্যুতে জরথ্রুষ্ট্রীয় সৎকারের সংস্কারটি বজায় রেখে একটি ইসলামি সমাজে সংরক্ষণ করা হচ্ছে একটা দোলনার মধ্যে ঘাস দিয়ে তৈরি মৃতের প্রতীকি অবশেষ। মৃদু স্পর্শে ঠেলে দিয়ে আসা হচ্ছে সেই দোলনা। নিঃশব্দ পাহাড় অটল ঠিকই, কিন্তু মানুষের মধ্যে এই পিতৃপ্রয়াণ নিঃসন্দেহে আসন্ন পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
এই উপন্যাসের আর সব সংকেত, জ্ঞান, ইতিহাস চেতনা বিস্মৃত হয়েও পাঠকের স্মৃতিতে রয়ে যাবে যে প্রতীকটি সেটি হল বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠে কথা বলে ওঠা ওই নীল পুতুল শবতী। ইতিহাসের সমস্ত ডিটারমিনিস্টিক তত্ত্বের উর্দ্ধে উঠে ঐ পুতুল বলে যায় সভ্যতার, পরিস্থিতির, প্রতিটি বাঁকে এসে শাশ্বত মানুষের চেতনাই ইতিহাস গড়ে দিয়েছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে, কোনও কার্য-কারণের অলঙ্ঘ্য নিগড়ে হাত-পা বাঁধা হয়ে মানুষ অসহায়ভাবে ইতিহাস তৈরি হতে দেখেনি।
তাই এই কাহিনীর শেষ পরিচ্ছেদে যখন তপস্বী দেখছেন পরবর্তী অধিষ্ঠানের দিকে স্বর্ণপাত্র ভেসে চলেছে স্রোতের বিপরীতে, ততক্ষণে পাঠক জেনে গেছেন বিপরীত বলে কোনও অভিমুখ নেই, অধিষ্ঠানই সত্য। কাওয়াবাতার উপন্যাসের পাহাড় থেকে শব্দ এসেছিল মৃত্যুর দ্যোতনা নিয়ে, এই উপন্যাসের চিরবিরাজমান বর্তমানের পরিসমাপ্তি কোথায়! এই উপন্যাসের পাহাড়কে তাই ‘নিঃশব্দ’ ছাড়া আর কোনও আখ্যা দেওয়াই যেতো না।
- দীপ মন্ডল
Comments