top of page
Writer's picturemanikarnikapub

শিশুদের ইস্কুলে যেদিন ক্ষেপণাস্ত্র এল । শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়


 

অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েছে রিপন। কাউকে বলতেও পারছে না খুলে। অথচ ভেতরে ভেতরে ঘুণপোকার মতো কাটছে অস্বস্তিতা। অফিস যাচ্ছে, আসছে। খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে। বাইরে থেকে সব ঠিকঠাক। কিন্তু সমস্যাটা ওই ঘুমের মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে।

বহুদিন হয়ে গেল কোনো স্বপ্ন দেখছে না রিপন! প্রথম প্রথম অতটা খেয়াল করেনি। কিন্তু অনেক দিন হয়েছে ব্যাপারটা মাথায় এল ওর। ওর ঘুম থেকে নিঃসাড়ে কে চুরি করে নিয়ে গেছে সমস্ত স্বপ্ন।

এককালে প্রচণ্ড স্বপ্ন দেখত রিপন। এমনকি মিনিট দশেকের দিবানিদ্রাও থইথই করত স্বপ্নে। মনে পড়ে, স্বপ্নে খুব পদ্মফুল দেখত রিপন। এ-স্বপ্নে ও-স্বপ্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত পদ্ম। গোলাপি পদ্ম, লালপদ্ম, শ্বেতপদ্ম। এছাড়া প্রায়ই দেখত মস্ত একটা নাগরদোলা। তার গায়ে রঙিন কত টিউবলাইট আটকানো। মেলার মাঠের একধারে মস্ত জন্তুর মাথা ঘোরানোর মতো করে সেটা ঘুরছে। আর নাগরদোলার একটা বাক্সে কখনও বসে আছে ওরা চারজন – মা, বাবা, দিদি, আর রিপন। কখনও বা ও আর ওর প্রাণের বন্ধু রাজু।

নাগরদোলার স্বপ্নটাই বেশি প্রিয় ছিল রিপনের। পদ্মফুলের স্বপ্নগুলো বড়ো বেশি শান্ত।

আজ আর কোনোটাই আসে না। একদিন আমতা আমতা করে স্ত্রীকে জানাল রিপন। ওর অসহায়তা দেখে বন্ধুর মতোই হাসল মধুরা – অমন হয়। চিন্তা করতে নেই। রাইটার্স ব্লকের মতো ড্রিমার্স ব্লক। একদিন দেখবে ঠিক চলে আসবে। অত ভেবো না।

ব্যাপারটা কেমন যেন গুরুত্ব পেল না ওর কাছে। সত্যিই কি ফেলনা বিষয় এটা? বয়স বাড়লে তবে কি স্বপ্ন চলে যায়?


। ২।


মধুরার উপেক্ষাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না রিপন। মাকে ফোন করে বলল কথায় কথায়। মা বলল, শরীরটা গরম হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। সকালবেলা মৌরি ভেজানো জল খা নিয়ম করে। ভালো ঘুম হবে। হয়তো তখন ফিরে আসবে…

এমন হয় নাকি! স্বপ্নদের ফিরিয়ে আনবার জন্য মৌরির জল! ধুর!

দুজন কলিগকে বলেছিল সামান্য ঠাট্টাচ্ছলেই। তারা বিষয়টা বুঝতেই পারল না। একজন তো বলে দিল একটা বেশি করে টিভি সিরিয়াল দেখতে। স্বপ্নের প্রচুর কাঁচামাল নাকি পাওয়া যাবে! বোঝো!

রাজুর সঙ্গে কথা নেই বহুকাল। একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য ওদের আশ্চর্য বন্ধুত্বটা ভেঙে গেছে। রাজু এখন পুরোদস্তুর লেখক। মূলত কবিতা লেখে। মাঝে মাঝে গল্প-উপন্যাস বেরোয়। তবে কবিতাটাই ওর সত্তার অক্ষ, জানে রিপন।

রাজুর কবিতাকে কত ঠাট্টা করেছে এককালে, এখন মনে পড়লে লজ্জা করে। রাজু গম্ভীর মুখে নতুন ইস্কুল বা বইমেলার ফিতে কাটে, সেসব ছবি বেরোয়, টিভিতে দেখায়। রিপনের বুকের ভেতরে অহংকারের গোপন ঢেউ খেলে যায় – আমার বন্ধু! আমার বন্ধু রাজু!

রাজুর নাম্বারটা একবার খোঁজ করে দেখলে হয়। শেষ কথা হয়েছিল বছর পনেরো আগে। তখন ওরা কলেজ পড়ুয়া। এতদিনে নিশ্চয়ই রাজুর নাম্বার বদলেছে।

চেনা-পরিচিত বন্ধুবান্ধবের থেকে রাজুর ফোন নাম্বার সন্ধান করে রিপন। আর খোঁজে স্বপ্ন। তন্নতন্ন করে খোঁজে। নইলে জীবনের মহান প্রাঙ্গণটাকে কেমন রিক্ত মনে হয়। গন্ধহীন ফুলের মতো সে যেন কোনো পূজাতেই লাগবে না আর!


। ৩।


ফোন নাম্বারটা একদিন পেয়ে যায় রিপন, কমন এক ক্লাসফ্রেন্ডের থেকে। অজয়। ওর কাছে নাম্বারটা আছে। রিপিন নাম্বার চাইতে ও অবাক হয়। শহরের সবাই জানত ওরা দুজন হরিহর আত্মা!

তোর কাছে রাজুর নাম্বার নেই! সে কী রে! কেন?

যে পৃথিবীতে রাত্তিরের ঘুমে স্বপ্ন থাকে না, সেইখানে বন্ধুত্ব থাকবে তুই আশা করিস!

ওরে বাব্বা! আমি এসব জানি না। একবিন্দুও বুঝি না। ফিলোজফি একলাইনও পড়িনি কখনও। এই নে নাম্বার পাঠালাম হোয়াটসএ্যাপে। তুই কথা বলে নিস। আর পারলে দেশবন্ধুর দিকে আসিস কখনও, আড্ডা মারা যাবে।

একদিন রাজুকে ফোন করল রিপন।

আমি রিপন।

(সামান্য চুপ)

হ্যালো। শুনতে পাচ্ছিস।

বল।

কেমন আছিস?

ভালো। তুই?

ভালো। না… ভালোই বলতে পারিস। তবে আমি খুব ভালো নেই।

কী হয়েছে?

একটা সমস্যা হচ্ছে।

ও। ওয়র্ক লাইফ?

না।

বেশ। আশা করি কাটিয়ে উঠবি দ্রুত।

রাজু, তোকে বলব সবটা?

আমাকে?

হ্যাঁ। বলব রে?

আমাকে… কেন?

কেন তোকে নয়? তোকেই তো…

আচ্ছা, বল।

তুই তো জানতিস আমি খুব স্বপ্ন দেখতাম।

মনে আছে।

খুব মানে খুব।

হ্যাঁ।

অনেকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি না রে। একটাও স্বপ্ন নেই। খাঁ খাঁ করা মস্ত তেপান্তর মাঠের মতো একটা ঘুম শুধু পড়ে আছে রাত জুড়ে। একটা গাছ নেই, ঘাস নেই। কী ধুধু ঘুম। বিষণ্ণ। রুক্ষ। আমার ভালো লাগছে না। একেবারে ভালো লাগছে না রে।

(চুপ)

তুই কি কোনো সাজেশন দিতে পারিস?

আমি দিতে পারি কেন মনে হল তোর?

জানি না। জানি না রে…

তুই জানিস সোরানে যুদ্ধ লেগেছে।

জানি।

একটু আগেই একটা শিশুদের ইস্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে ক্ষেপণাস্ত্রে। খবরে দেখাচ্ছে। সেটা দ্যাখ। কাল সকালে ফোন করিস পারলে। টিভি চালিয়ে খবরটা ভালো করে দ্যাখ। ইচ্ছে না করলেও যতটা পারিস দ্যাখ। দেখতে থাক।


। ৪।


খবর চালিয়ে দেখল রিপন। গা শিউরে উঠছিল। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে ধ্বংসভূমির। পোড়া শিশু, রক্তাক্ত শিশু। কংক্রিটের চাঙড়ের নীচে থেঁতলে যাওয়া শিশু। এক শিক্ষকের মৃতদেহের আড়াল থেকে উদ্ধার হল জীবিত দুই পড়ুয়া। শেষ মুহূর্তে ওদের আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও ওদের বলে গেছেন পৃথিবীতে হিংসাই শেষ কথা নয়। দুটি অবোধ প্রাণকে শরণ দিয়ে নিজে চলে গেলেন শিক্ষক।

রাজু অত জোর দিয়ে না বললে এই কভারেজ এক মিনিটও দেখত না রিপন। পৃথিবীর বিষয়ে ওর এতখানি আগ্রহ নেই যে এই নৃশংসতাকে পা দুলিয়ে দুলিয়ে উপভোগ করতে পারে।

এই পৃথিবীতে স্বপ্ন আসে না।

এই পৃথিবীতে প্রাণের বন্ধু অচেনা হয়ে যায়।

এই পৃথিবীর শিশুরা পড়াশোনা করতে করতে এক লহমায় দূরের ক্ষেপণাস্ত্রে জ্বলে যায়।

খিদে পায় না রিপনের। আলাদা একটা ঘরে একলা শুয়ে পড়ে ও। দরজা বন্ধ করে দেয়। ফ্যানের শব্দ হয়। জানলার কাচে নিঃশব্দ ও রকমারি ঠাট্টার মতো খেলা করে বাইরের আলো।


। ৫।


সকাল না হতেই ফোন করে রাজুকে।

উঠেছিস?

হ্যাঁ বল।

দেখলাম!

কী? ওই খবর?

হ্যাঁ। কিন্তু… কিন্তু…

কিন্তু কী?

তার চেয়েও বড়ো কথা… আমি স্বপ্ন দেখেছি… রাতভর স্বপ্ন দেখেছি… জানিস… এতদিন পরে স্বপ্ন এল…

জানি।

জানতিস?

হুঁ।

কেমন করে?

কী স্বপ্ন দেখলি আগে বল? ছোটোদের নিয়ে কোনো স্বপ্ন?

ঠিক ধরেছিস। দেখলাম একটা নীল রঙের বাড়ি। দোতলা বোধহয়, নাকি একতলা… ঠিক মনে নেই… সামনে অনেকখানি বাগান। সেখানে ছোটোরা থাকে। পড়াশোনা করে। খেলা করে। ওদের কোনো ভয় নেই সেখানে। মৃত্যুভয় নেই। বিচ্ছেদের কাতরতা নেই। ওদের ঘুমে স্বপ্ন আসে। একটা ক্লাস আছে শুধু স্বপ্ন নিয়ে। সেখানেই কেউ পড়ায় না। কিছু লেখায় না। কোনো সিলেবাস নেই। সঙ্গে থাকে শুধু সাদা পাতা আর রংপেন্সিল। সেই ক্লাসে বাচ্চারা একজন একজন শোনায় কী স্বপ্ন দেখেছে গত রাতে। বাকিরা মন দিয়ে শোনে। কোনো স্বপ্ন মনে ধরে তাকে ছবিতে ধরে ফেলে।

তারপর?

সেই ইস্কুলটা কারা চালায় জানিস?

কারা?

দুই বন্ধু।

আহা…

তুই আর আমি! আমরা দুজনে চালাই ইস্কুলটা!

আর?

ইস্কুলের মাঠে একটা আশ্চর্য নাগরদোলা। সেটা আপনাআপনি ঘোরে। তার সারা গায়ে সবুজ একরকম লতা উঠেছে। মৃদু একটা আভা বেরোয় তার গা থেকে। আর কোনো শিশু উঠতে চাইলে সেটা আস্তে আস্তে থেমে যায়। কেউ নামতে চাইলেও থেমে যায়। কাউকে বলতে হয় না, কোনো সুইচ টিপতে হয় না।

কী সুন্দর রে…

ঠিক যেন আমাদের মেরিপার্কের সেই নাগরদোলা। সেই যে, বছর বছর আসত, তোর মনে আছে?

থাকবে না!

একদিন আমরা ইস্কুলে ঢুকছি

কোত্থেকে ঢুকছি? আমরাও তো ওই বাড়িতেই থাকি নাকি!

হ্যাঁ ওখানেই থাকি। কিন্তু কোথাও গিয়েছিলাম হয়তো।

আচ্ছা। তারপর?

ঢোকবার সময় দেখছি বাচ্চারা সব সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাঠে। আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। ওদের সকলের হাতে একটা করে পদ্মফুল। সেদিন বেশ কুয়াশা পড়েছে। আর কুয়াশার ভেতরেই একটা কী যেন পাখি খুব ডাকছে। আমরা তো অবাক! ওদের একজন একজন করে পার করে করে হাঁটছি, আর ওরা আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে ফুল।

কেন ফুল দিচ্ছে?

ওরা খবর পেয়েছে, পৃথিবীর এক শিশুইস্কুলে গতকাল বোম পড়েছে। কত শিশু মারা গেছে। কিন্তু ওরা জানে ওদের ভয় নেই। দুই বন্ধু রয়েছে ওদের পাহারায়। তাই ওরা ভালোবাসা জানাচ্ছে। নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে আমাদের কাছে। বলতে চাইছে তোমরা একসঙ্গে আছ বলে আমরা বাঁচতে পারছি। আমরা শরণাগত। আমরা আনন্দে আছি। তোমাদের অভিনন্দন। বন্ধুদের থেকে বড়ো শক্তিমান, বড়ো প্রহরী আর কে হতে পারে বল…

আমি জানতাম এই খবর দেখলে তুই স্বপ্ন দেখবি। আমাদের জীবনে আসলে তেমন কোনো সংকট নেই তো। মৌলিক কোনো সংকট। যাকে বলে ক্রাইসিস। তাই স্বপ্ন আসে না। ফুটফুটে শিশুদের রক্ষা করতে না পারার হতাশা যদি ক্রাইসিস তৈরি না করে, তাহলে তো আমরা মৃত। তাই খবরটা দেখতে বললাম। একটা ফোর্স যদি না তৈরি হয় ভেতরে, স্বপ্ন আসবে কেমন করে। স্বপ্নের ভেতর দিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। সামনের দিকে। এগোনোর জন্য একটা বল তো দরকার। কিন্তু… কিন্তু অত পদ্ম ওরা পেল কোথা থেকে?

কেন? এই তো এবারের ‘কালচক্র’-এর কবিতার পাতায় তুই লিখেছিস না:

‘হে পদ্মের দিঘি, তুমি তো বাইরের কোলাহল থেকে

কবে সরে গেছ একেবারে। এই চলে যাওয়ার কোনো

শব্দ ছিল না।

লোকে কৃপণ বলে, মৃতবৎসা বলে তোমায় রোষভরে

কিন্তু আমি জানি – তুমি আজ বুকের ভেতর

ঘন ও অতল

ডাকলে সাড়া দাও দিঘিভরা ফুলে…

কত ফুল… আহা ফুল…’

তুই আমার লেখা পড়িস?

পড়ি। যতটা পাই পড়ি। এছাড়া আর কোন উপায়েই বা তোকে ছুঁয়ে থাকতে পারতাম রাজু, বল…



[আলোকচিত্র : রাহুল চৌধুরী]


 

55 views0 comments

Comments


bottom of page